ভয়ংকরভাবে নির্যাতন করে বাস ডাকাতি,  ৫৪ ধারায় মামলা ,আদালতে অভিযুক্তদের জামিন

  • বৃহস্পতিবার, ২০ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫
ভয়ংকরভাবে নির্যাতন করে বাস ডাকাতি,  ৫৪ ধারায় মামলা ,আদালতে অভিযুক্তদের জামিন# সংংবাদ শৈলী

স্টাফ রিপোর্টার
গত ১৭ ফেব্রুয়ারী ইউনিক রোড রয়েলস বাসের যাত্রীদের কাছ থেকে দফায় দফায় নির্যাতন চালিয়ে প্রায় ৩ঘন্টা ধরে ডাকাতি করে যাত্রীদের সর্বস্ব লুটে নেয় ডাকাতদল। এ ঘটনায় যাত্রীরা অভিযোগ করলেও ৫৪ ধারায় আটক বাসের চালক হেলপার ও সুপার ভাইজারের জামিন হয়ে যায়। সেদিনের বাস যাত্রীদের মুখে উঠে এসছে সেই ভয়াবহ চিত্র।
ঢাকায় বাসে ফিরছিলেন বড়াইগ্রামের ওমর আলী । তিনি বলেন ঢাকা থেকে রাজশাহী গামি ইউনিক রোড রয়েলস বাসে করে বাড়ি ফিরছিলেন। গাড়ী ছাড়ার মুহুর্তে কয়েকজন যাত্রীর কানে কানে বাসের হেলপারের কথা বলতে দেখি। এরপর বাইপাইল এসে কয়েকজন যাত্রীকে বাসে তুলেন। বাসটি টাঙ্গাইলের মির্জাপুর এলাকায় এসে পৌঁছিলে বাসের মদ্যে থাকা কয়েকজন ডাকাত অস্ত্রহাতে তাদের জিম্মি করে টাকা পয়সা লুট করে নেন। তিনি বলেন, তার সাথে ব্যবসায়িক পার্টনার সোহাগ হোসেন ছিলেন । তাদের কাছে থাকা সুপারি ও খেজুরের গুড় বিত্রি করার সব টাকা লুটে নেয় ডাকাত দল। এসময় বাসের অন্যান্য যাত্রীসহ নারী যাত্রীরাও ডাকাতদলের হাত থেকে রক্ষা পাননি।
গত ১৭ ফেব্রুয়ারী মাঝরাতে ইউনিক রোড রয়েলসের আমরী ট্রাভেলস নামের একটি বাসে (নম্বর ময়নসিংহ-ব-১১-০০৬৯) এই ডাকাতি হয়েছে। গাজীপুরের চন্দ্রা থেকে টাঙ্গাইলের মির্জাপুর এলাকার মধ্যে এই ডাকাতি হয়েছে। যাত্রীরা জানান, ডাকাতি হওয়া বাসটি নাটোরের বড়াইগ্রাম থানায় পৌঁছানোর পর দুই নারী যাত্রী তাদের কাছ থেকে স্বর্নালংকার শ্লীলতাহানির অভিযোগ করেছেন। তবে বড়াইগ্রাম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) বলছেন, নারী যাত্রীদের নির্যাতন বা ধর্ষণের ঘটনার কথা কেউ তাঁকে বলেননি। এ ঘটনায় এখনো কোনো মামলা হয়নি।
বাসের যাত্রী সোহাগ হোসেন, ওমর আলী, মজনু আকন্দ (৭৩) এবং তাঁদের ব্যবসায়িক অংশীদার আবু হানিফ বাস আটকানোর পর থেকে আজ বৃহস্পতিবার বিকেল পর্যন্ত বড়াইগ্রাম থানায় অবস্থান করছিলেন। তাঁরা মামলা করতে চাইছেন। কিন্তু পুলিশ বলছে, ঘটনাস্থল মির্জাপুর থানা এলাকা হওয়ায় সেখানেই মামলা হবে। বৃহস্পতিবার বিকেল পাঁচটার সময় ওমর আলী প্রথম বলেন, ইতিমধ্যে নাটোরের পুলিশ সুপার তাঁদের বক্তব্য রেকর্ড করে নিয়ে গেছেন। মির্জাপুর থানার পুলিশ বড়াইগ্রাম থানার উদ্দেশে রওনা দিয়েছে বলে তিনি শুনেছেন।
বাসযাত্রীরা বলছেন, ৪০ জনের মতো যাত্রী নিয়ে সোমবার রাত ১১টায় ঢাকার গাবতলী থেকে রাজশাহীর উদ্দেশে বাসটি ছাড়ে। রাত ১২টা ৩৫ মিনিটে বাসে ডাকাতি শুরু হয়। তিন ঘণ্টা ধরে ডাকাতি শেষে ঘুরিয়ে একই জায়গায় বাসটি নিয়ে গিয়ে রাত ভোর ৪টার দিকে ডাকাতেরা নেমে যান। তখন যাত্রীরা দেখতে পান, তাঁদের অবস্থান মির্জাপুর থানা এলাকার একটি পেট্রলপাম্পের পশ্চিম দিকে। সেখানে বাসচালক, তাঁর সহকারী ও সুপারভাইজার গন্তব্যে না যেতে নানা টালবাহানা করতে থাকেন। তবে যাত্রীদের চাপের মুখে তাঁরা বাস ছাড়েন। মঙ্গলবার বেলা ১১টা থেকে সাড়ে ১১টার দিকে বাসটি যাত্রীদের চাপের মুখে বড়াইগ্রামে থানায় ঢোকানো হয়।
ঘটনার বর্ণনা দিয়ে সোহাগ হোসেন বলেন, গাবতলী থেকে বাসটি ছাড়ার সময় পেছনের সিটে তিনজন ডাকাত উঠেছিলেন। বাসের লোকজনের সঙ্গে এই তিনজন কথা বলে কিছু দূর এসে আরও পাঁচজনকে বাসে ওঠানো হয়। তারপর ডাকাতদের একজন বাসের স্টিয়ারিংয়ের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। এই ডাকাতেরা একজন যাত্রীকে ছুরিকাঘাত করেন। এতে তাঁর সাদা জামা রক্তে ভিজে যায়। তখন ওই যাত্রী তাঁর টাকাসহ সবকিছু বিনা বাক্যে দিয়ে দেন। আরেকজনের হাতে ছুরি দিয়ে পোজ (আঘাত) দেয়। তাঁর হাতের মাংস কেটে ফাঁক হয়ে যায়। এই ভয়ে যাত্রীরা যাঁর কাছে যা ছিল সব দিয়ে দেন।


প্রত্যেক যাত্রীকে ডাকাতেরা একাধিবার তল্লাশি করেন উল্লেখ করে সোহাগ আলী বলেন, তাঁকে একজন ডাকাত বাসের সিটের মাঝখানে ফেলে দিয়ে বুকের ওপর পা তুলে দিয়ে দাঁড়ায়। এই সময় তাঁর ব্যবসায়িক অংশীদার ওমর আলীর গলায় ছুরি ধরে ২০ হাজার টাকা বের করে নেয়। এ সময় ওমর আলী এক লাখ টাকার বান্ডিলটি নিচে ফেলে দেন। পরেরবার তল্লাশি করতে এসে ডাকাতেরা সেই টাকাটাও পেয়ে যায়। কোনো যাত্রীর মোবাইল ডাকাতেরা রেখে যায়নি। শুধু তাঁর ফোনটি নিচে পড়ে যাওয়ার কারণে তাঁরা বুঝতে পারেনি।
আরেক যাত্রী বড়াইগ্রামের মৌখাড়া গ্রামের মজনু আকন্দের ৪৬ হাজার টাকার সব কেড়ে নিয়েছে ডাকাতেরা। তিনি বলেন, ‘বাসে মেয়েদের তারা (ডাকাতেরা) লাঞ্চিত করেছেন। মেয়েদের কাছথেকে তারা প্রায় বিবস্ত্র করে স্বর্নালংকার ও টাকা পয়সা ছিনিয়ে নেয়। ’ তিনি আরও বলেন, তিন ঘণ্টা ধরে বাস শুধু ওই এলাকায় ঘুরিয়ে সব যাত্রীর টাকাপয়সা, স্বর্ণালংকারসহ সবকিছু লুট করে নেওয়ার পরে ডাকাতদের নামিয়ে দেওয়া হয়। ওমর আলী বলেন, ‘দুই নারী যাত্রী তাদের কাছে একাধিকবার বলেছেন যে ডাকাতেরা তাদের শ্লীলতাহানি ঘটিয়েছে। তারা ঘটনাটি বড়াইগ্রাম থানার সেকেন্ড অফিসার শরিফুলের (এসআই শরিফুল ইসলাম) কাছেও বলেছেন। ওই বাসেই ছিলেন চারঘাটের এক নারী যাত্রী। তিনি ঢাকায় মেয়ের বাসা থেকে বাড়ি ফিরছিলেন। তাঁর কাছ থেকে ডাকাতেরা সাড়ে ৭ হাজার টাকা, সোনার বালা ও চেইন নিয়েছে দাবি করে তিনি মোবাইল ফোনে বলেন, সেদিন রাতে ডাকাতির পর বাসটি প্রথমেই মির্জাপুর থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। ওই থানার পুলিশ তাদের কোনো কথাই শুনতে চায়নি। তারা বলেছেন ওসি না আসলে তারা কিছুই বলতে পারবেন না।ওসি সকাল ৯ টার আগে আসবেন না। এই অবস্থায় নিরাপত্তার কোনো নিশ্চয়তা না পেয়ে তারা বড়াইগ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। ওই নারী আরও বলেন, ‘যেসব মেয়েরা গয়না খুলতে দেরি করেছে, তাদের সঙ্গে খুব জোর খাটিয়েছে, তাঁদের শ্লীলতাহানি ঘটিয়েছে।’
মির্জাপুর থানার ওসি মোশারফ হোসেন বলেন, মঙ্গলবার ভোরে কিছু লোকজন থানায় এসেছিলেন বলে তিনি জেনেছেন। মির্জাপুর থানা থেকে পুলিশ তাদের কথা শোনার জন্য বসতে বলেন। কিন্তু তারা পুলিশের সঙ্গে উল্টো রাগারাগি করে চলে যান। তাদের কথা পুলিশ শোনেনি এই অভিযোগ সত্য না। ওই লোকজন এই ঘটনার শিকার কিনা তা খোঁজাসহ আগামীকাল সকাল দশটার মধ্যে প্রকৃত ঘটনা ও স্থান জানা যাবে বলে ওসি জানিয়েছেন।
বাসচালকসহ তিনজন জামিনে মুক্ত
ডাকাতির ঘটনায় আটক বাসের সুপারভাইজার, চালক ও চালকের সহকারী জামিনে মুক্তি পেয়েছেন। বুধবার সন্ধ্যায় জামিন পেলেও বিষয়টি আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে আদালত সূত্রে বিষয়টি জানা যায়। নাটোরের বড়াইগ্রাম আমলী আদালত সূত্রে জানা যায়, বড়াইগ্রাম থানার এসআই শরিফুল ইসলাম স্বাক্ষরিত চালান মূলে ঢাকা-রাজশাহী চলাচলকারী ইউনিক রোড রয়েলস বাসের চালক বাবলু ইসলাম (৩৫), চালকের সহকারী সুমন ইসলাম (৩৫) ও সুপারভাইজার মাহবুল আলমকে (৩৮) বুধবার বিকেলে আদালতে পাঠানো হয়। সন্ধ্যায় তাঁদের আদালতের সামনে হাজির করলে আদালত শুনানি শেষে জামিনের আদেশ দেন।
আদালত পুলিশের পরিদর্শক মোস্তফা কামাল বলেন, মামলাটি ফৌজদারি কার্যবিধি ৫৪ ধারার হওয়ায় এবং আসামিদের বিরুদ্ধে কোনো ধর্তব্য অপরাধের অভিযোগ সুনির্দিষ্ট না থাকায় আদালত তাঁদের জামিনের আদেশ দেন।

বড়াইগ্রাম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সিরাজুল ইসলাম বলেন, বাসের যাত্রীরা মৌখিকভাবে পুলিশকে ডাকাতি হওয়ার কথা বলেছেন। অনেক যাত্রীই রাস্তায় নেমে গেছেন। দুজন নারী যাত্রী এসেছিলেন। তাঁদের একজনের বাড়ি নাটোরের লালপুরে, আরেকজনের বাড়ি রাজশাহীর পুঠিয়ার দিকে। তাঁরা তাঁদের নির্যাতনের ব্যাপারে কোনো কথা বলেননি। তাঁরা চলে গেছেন। তাঁদের মুঠোফোন নম্বরও তাঁর কাছে নেই।
নাটোরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শারমিন নেলী বলেন,যেহেতু ঘটনাটি তাদের আওতার মধ্য্যে হয়নি এবং কেউ লিখিত অভিযোগ করেননি সেকারণে সন্দেহভাজন ব্যক্তি হিসেবে তাদের ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। তিনি বলেন বিষয়টি মির্জাপুর থানাকে জানানো হয়েছে। তারা যৌথ ভাবে বাস ডাকাতির বিষয়টি তদন্ত করছেন। তবে অকুস্থল মির্জাপুর হওয়ায় ওই থানায় ডাকাতির মামলা হবে।

Please Share This Post in Your Social Media

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category

COPYRIGHT 2023 sangbadshoily, ALL RIGHT RESERVED
Site Customized By NewsTech.Com