স্টাফ রিপোর্ঢার
ঢাকা ড্রিম হোম ট্রাভেরস্ এন্ডে ট্যুরস লিঃ নামে একটি প্রতারক প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন কারখানা ও ক্যান্টনমেন্টে মালি বা বাবুর্চির কাজ দেওয়ার কথা বলে তরুণদের পাঠানো হয় রাশিয়ার যুদ্ধক্ষেত্রে। সেখানে অকাতরে প্রাণ হারাচ্ছে অনেকে। শুধু এক এজেন্সির মধ্যস্থতায় পাঠানো ১০ তরুণের মধ্যে আটজন যুদ্ধে জড়াতে বাধ্য হয়েছেন বলে খবর পাওয়া গেছে। এঁদের মধ্যে অনেকের কোনো খোঁজ মিলছে না।সংসারে সচ্ছলতা আর সন্তানদের ভবিষ্যতের আশায় রাশিয়ায় পাড়ি জমিয়েছিলেন নাটোরের সিংড়ার হুলহুলিয়া গ্রামের হুমায়ুন কবির ও তার দুলাভাই রহমত আলী। কিন্তু সেখানে চাকরির নামে তাদের পাঠানো হয় ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধে। যেই যুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছেন হুমায়ুন কবির। আর দুলাভাই রহমত আলী ফিরতে চান দেশে।
একমাত্র ছেলের মৃত্যু আর জামাইকে ফিরে পেতে অসহায় কারিমুন বেগমের চোখের পানি যেন শুকিয়ে গেছে ।ছেলেকে তো হারিয়েছি জামাইকেও জোর করে যুদ্ধ পাঠানো হয়েছে । দুই মেয়ে নাতি নাতনি নিয়ে এই পাঁচ জনের সংসারে কি করে আমাদের দিন কাটবে ভেবে পাচ্ছি না । সন্তানদের মুখের দিকে তাকাতে পারছি না। বুক ফেটে কান্না আসলেও তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে নিজেকে শক্ত রাখার চেষ্টা কর করছি। যারা প্রতারণা করে আমার ছেলে এবং জামাইকে বিদেশে পাঠালো, ছেলেটা মারা গেল আমি তাদের বিচার চাই। সরকারের কাছে দাবি জানাই আমার সন্তানের লাশ যেন দেশে ফিরিয়ে আনা হয় এবং আমার জামাইকে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে উদ্ধার করে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়। রাশিয়া- ইউক্রেন যুদ্ধে নিহত হুমায়ুন কবিরের স্ত্রী তারা বেগম কাঁদতে কাঁদতে বলেন আমার তো সব শেষ আমি সে মুখ দেখতে পারব কিনা জানিনা আমার এক বছর তিন মাস বয়সী অজিয়া প্রীতিসহ পাঁচ সদস্যের দিন কাটবে কিভাবে আমি জানিনা। আপনাদের কাছে আমার দাবি আমি যেন আমার স্বামীর মৃতদেহ চোখে দেখতে পাই আর আমার দুলাভাই কেও দেশে ফিরিয়ে আনা হয় তিনি বলেন আমাদের জমা জমি বলতে তো আর কিছু নাই আমরা চলবো কি করে কি খাব আমার সন্তান কিভাবে বাঁচবে কিছুই বুঝতে পারছি না আমার দু চোখে কেবলই রাতের অন্ধকার আপনাদের কাছে আমার দাবি আমরা যেন দালালের বিচার পাই এবং আমার মত আর কোন মেয়েকে স্বামীহারা অথবা আর কোন শিশুকে বাবা হারা হতে না হয়। যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠানো রহমত আলী স্ত্রী যমুনা খাতুন তার তিন বছরের মেয়ে নাদিয়া আফরিনকে কোলে নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলেন আর চার দিন ধরে তার সাথে আমার কোন কথা নেই আমার মেয়েটা তার বাবার সঙ্গে কথা বলতে চায় কান্নাকাটি করে । কিন্তু কি করে ওকে বলবো তার বাবার সঙ্গে আমরা যোগাযোগ করতে পারছি না সে বেঁচে আছে না মরে গেছে তাও জানিনা ।আমার একটাই দাবি যে দালালেরা প্রতারণা করে আমার স্বামী ও ভাইয়ের কাছ থেকে ১৮ লাখ টাকা নিয়ে বিদেশ পাঠানোর নাম করে যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠিয়েছে তাদের যেন বিচার করা হয়।
শনিবার সকালে সিংড়া উপজেলা সদর থেকে ১৮ কিলোমিটার দূরে জেলার আদর্শ গ্রাম হিসেবে পরিচিত হুলহুলিয়া গ্রামের কবির হুমায়ুনের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, পুরো বাড়িতে শোকের ছায়া। ছাপরা ঘরের বারান্দায় বসে আছেন মা ও দুই মেয়ে। তাদের কোলে ৩ বছরের সন্তান নাদিয়া আফরিন ও এক বছর তিন মাস মাস বয়সে সন্তান ওয়াজিয়া প্রীতি। আমাদের দেখেই কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন তারা। পুরো বাড়িতে দারিদ্র্যের ছোঁয়া। একটি টিনের ছাপরা ঘর ও একটি ইট দিয়ে প্লাস্টার বিহীন ছাপড়া ঘর এরমধ্যে তাদের পাঁচ জনের বসবাস। রাশিয়া যাওয়া রহমত আলী স্ত্রী যমুনা খাতুন কাঁদতে কাঁদতে বলেন ভাই ও আমার স্বামীর ভাগ্য ফেরানোর জন্য পৈতৃক ৫ বিঘা সম্পত্তি বন্ধক দিয়ে ১৮ লাখ টাকা দেওয়া জোগাড় করে দিয়ে তুলে দিয়েছিলেন দালালের হাতে। তারা সৌদি আরব এক মাস রেখে রাশিয়ায় বিক্রি করে দেয়। সেখানে তাদেরকে দিয়ে জোর করে যুদ্ধের ট্রেনিং নেওয়া সহ আমার ভাইকে যুদ্ধে পাঠানো হয়। চার দিন আগে ফোনে কাঁদতে কাঁদতে স্বামী রহমত আলী জানান তাকেও যুদ্ধের ট্রেনিং দেওয়া হয়েছে, আগামীকাল থেকে তাকেও যুদ্ধে পাঠিয়ে দেওয়া হবে ।আমি যুদ্ধ জানিনা। কবির তো যুদ্ধে মারা গেছে আমি বেঁচে ফিরে আসতে পারবো কিনা জানিনা। তোমরা আমাকে দেশে ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা কর। না হলে আমি মরেই যাব।যমুনার দুলাভাই দুলাল তালুকদার বলেন, হুলহলিয়া গ্রামের সাইপ্রাসের চাকরি করা সাখাওয়াত হোসেন ওরফে জয়ন তাদেরকে সাইপ্রাসে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে আড়াই লাখ টাকা নেয় ।পরে তিনি তাদেরকে সাইপ্রাসে নিতে না পারায় ড্রিম হোম ট্রাভেরস্ এন্ডে ট্যুরস লিঃ পরিচালক নারায়ণগঞ্জের হাসান নামের এক ব্যক্তির সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। সে মাসে আড়াই লাখ টাকা বেতনের চাকরির কথা বলে দুজনের কাছ থেকে ১৮ লাখ টাকা নিয়ে প্রতারণা করে রাশিয়ার কাছে বিক্রি করে দেয়। দুলাল তালুকদার বলেন আমার শ্বশুরের ৫ বিঘা জমি বন্ধক দিয়ে স্ত্রীর গহনা বিক্রি করে ১৮ লাখ টাকা দালালের হাতে তুলে দিয়েছিলেন
। তাদেরকে এক মাসের ভিসায় সৌদিতে নেওয়ার পরে রাশিয়াতে বিক্রি করে দেওয়া হয়। এরপর যুদ্ধে তার শ্যালক কবির হুমায়ন নিহত হয়। আমার ভাইরা রহমত আলী ফোন করে চার দিন আগে কান্নাকাটি করে জানান ,শুনতে পাচ্ছি তাকেও যুদ্ধে পাঠানো হবে ।তোমাদের সাথে আর কথা হবে কিনা জানিনা ।কারণ মাত্র পুরনো দিন ১৫ দিনের ট্রেনিং দিয়ে আমার হাতে অস্ত্র ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে আমি অষ্ট ধরতে জানি না যুদ্ধ করব কেমনে ।যুদ্ধে পাঠালে তাদের মোবাইল কেড়ে নেওয়া হয়। তোমরা যেভাবে পারো আমাকে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যাও এখানে থাকলে আমি মরে যাব আমাকে তোমরা বাঁচাও। তিনি বলেন এরপর তার ছেলে দুর্জয় কে ঢাকা ড্রিমল্যান্ড ওভারসিজ অফিসে পাঠিয়েছিলাম । প্রথম দিন কথা হয় তখন তারা রহমত আলীকে ফিরিয়ে আনার আশ্বাস দেয় এরপর থেকে তাদের অফিসে কারো সাথে যোগাযোগ করা যাচ্ছে না । দালাল হাসান আলী আমাদের আশ্বাস দিলেও এখন আর ঠিকমতো ফোন ধরে না আমরা কি করব বুঝতে পারছি না আমি সরকারের কাছের বিচার চাই আমি দাবি জানাই তাদেরকে দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য হুলহলিয়া সামাজিক উন্নয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান পরশ তৌফিক বলেন এটি খুবই দুঃখজনক ঘটনা তাদের সব কিছু বিক্রি করে সুখের আশায় দালালের হাতে টাকা তুলে দিয়েছিলেন এখন সব হারিয়ে এই পরিবারটি নিঃস্ব আমরা এ ঘটনার বিচার চাই। ভুল হলে সামাজিক উন্নয়ন পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান আমিনুল হক মন্ডল বলেন আমাদের গ্রামের দুটি ছেলে বিদেশি গিয়ে একজন মারা গেছে। এটি খুবই দুঃখজনক লোকজনকে যারা দেশে এবং দেশের বাইরে কর্মরত রয়েছে তাদের প্রত্যেকের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। এই পরিবারকে কিভাবে পুনর্বাসন করা যায় অন্যদিকে যে দালাল চক্র এই অন্যায় কাজটি করেছে তাদের বিষয়ে প্রশাসনকে অবহিত করেছে প্রশাসন ন্যায় বিচার দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন আমরা আশা করি এ ধরনের ঘটনা দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
এ বিষয়ে ঢাকা ড্রিম হোম ট্রাভেরস্ এন্ডে ট্যুরস লিঃ এর পরিচালক আবুল হাসানের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা হলে তার মোবাইলটি বন্ধ পাওয়া যায়।
এ বিষয়ে নাটোরের জেলা প্রশাসক আসমা শাহীন বলেন, তিনি কোন লিখিত আবেদন পাননি। আপনাদের মাধ্যমেই জানলাম। আবেদন পেলে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয়ের সাথে কথা বলে আমরা প্রয়োজনীয় ব্য্যবস্থা নেব।