জাকির তালুকদার
পৃথিবীর সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞানী মানুষটি পড়তে জানতেন না, লিখতেও।
তিনি খালিপায়ে অথবা ছেঁড়া পদাবরণ পরে ঘুরে বেড়াতেন ধূলিধূসরিত রাস্তায়। পরনে থাকত মলিন বসন। দেখতেও নাকি ছিলেন তুলনামূলক কদাকার। অধিষ্ঠিত ছিলেন না বড় কোনো পদে। অর্থাৎ চেহারা ও বেশবাসের কারিশমা দিয়ে কাউকে আকর্ষণ করার ক্ষমতাই ছিল না তাঁর। তবু যেখানেই তিনি যেতেন তরুণের দল ভিড় জমাত তাঁর পাশে। শহরের জ্ঞানী-বিদ্বান হিসাবে পরিচিত লোকেরা এড়িয়ে চলত তাঁকে। কারণ দুই-তিনটি নিরীহ প্রশ্ন তুলে সেই জ্ঞানীদের নিজেদের কাছেই তিনি প্রমাণ করে দিতেন তাদের জ্ঞানের মুখোশ কতটা আলগা। কী বলতেন তিনি তরুণদের? বলতেনÑ ‘অপরিক্ষীত জীবন কোনো জীবনই নয়। যে মন কখনো প্রশ্ন করতে শেখেনি সেই মন আদৌ মানুষের সাথে বিবর্তিত হতেই পারেনি।’
মুক্তচিন্তা শব্দটি হয়তো সেই জ্ঞানী সক্রেটিসের যুগে আবিষ্কৃত হয়নি। কিন্তু তিনি ছিলেন মুক্তচিন্তার মানবদেহী স্বরূপ।
তিনি নবী ছিলেন না। অন্তত নিজেকে কখনো নবী হিসাবে দাবি করেননি। কোনো ঐশ^রিক বাণী বহনের কৃতিত্ত¡ও দাবি করেননি। কিন্তু আজও সারা পৃথিবীতে তিনি ‘নিজেকে জানো’ বাণীর পয়গম্বর হিসাবে সম্মানীত।
প্রশ্নের শক্তি কত বেশি তা আমরা সর্বসাম্প্রতিককালে আমাদের দেশের আরজ আলী মাতুব্বরের মাধ্যমে দেখতে পেয়েছি। আর সক্রেটিস যেভাবে ধাপে ধাপে প্রশ্ন করতেন, সেই উদাহরণ আমরা পেয়েছি শিষ্য প্লেটোরে রচনা থেকে। একটু কল্পনার আশ্রয় নেয়া যাক।
ধরুন একজন বুদ্ধিজীবী নিজেকে মুক্তচিন্তক বলে দাবি করেন। তার সাথে সক্রেটিসের কথোকথন হতে পারে এই রকমÑ
Ñ আপনি কি নিজেকে মুক্তচিন্তক বলে মনে করেন?
Ñ অবশ্যই।
Ñ আপনার মতে মুক্তচিন্তা জিনিসটা কী?
Ñ নিজের চিন্তার চারপাশে কোনো গÐি টেনে না রাখা। কোনো অচলায়তনের মধ্যে নিজেকে আবদ্ধ না রাখা।
Ñ অচলায়তন বলতে কী বোঝাচ্ছেন?
Ñ যেখানে মুক্তবাতাস প্রবেশে বাধা দেওয়া হয়। নতুন প্রবাহে বাধা দেওয়া হয়। দশগিন্তের যেদিক থেকেই আসুক, সেই বাতাসকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়।
Ñ আপনি অচলায়তন ভেঙে ফেলেছেন?
Ñ হ্যাঁ।
Ñ সব বাতাস তো বিশুদ্ধ নয়। কোনো কোনো বাতাস মারি বহন করে আনে। আপনি কি সেই বাতাসকেও অবাধ প্রবেশাধিকার দেবেন?
Ñ না।
Ñ পরীক্ষা না করেই বাতিল করে দেবেন?
Ñ হ্যাঁ। কারণ আমি তো অন্যের অভিজ্ঞতা থেকে জেনেছি।
Ñ কোন কোন বাতাস উপকারী সেগুলোও কি আপনি অন্যের অভিজ্ঞতা থেকেই জেনেছেন?
Ñ হ্যাঁ।
Ñ তার মানে কি এটাই দাঁড়ায় না যে আপনি নিজে কিছুই পরীক্ষা করেননি?
Ñ হ্যাঁ।
Ñ তাহলে কি আপনি মনে করেন না যে মৌলিক কিছুই আপনি করেননি? আপনি অন্যের অভিজ্ঞতা নিয়েই জীবন যাপন করেন?
উত্তর আসে না।
Ñ এটাও তো অন্ধ অনুসরণই। অন্ধ অনুসরণকে কি আপনি মুক্তচিন্তা বলতে পারেন?
উত্তর আসে না।
এটাই আমাদের কাছে মুক্তচিন্তার স্বরূপ। কোনোকিছুকেই অন্ধ অনুসরণ নয়। না শাস্ত্র-শরিয়ত, না পাঁজি-পুথি, না ধর্মীয় বা বৈষয়িক কোনো ফতোয়া।
পৃথিবীজুড়ে সবকালে সবদেশেই মুক্তচিন্তকের সংখ্যা কম থাকে। কারণ মানুষ বাঁধা পথে চলতে অভ্যস্ত। নতুন পথ খোঁজা তার কাছে বিপজ্জনক কাজ। তাই মুক্তচিন্তকের কথা তার কাছে নতুন ঠেকে। অনেক সময় অবাস্তবও। তবে সেই অবাস্তবটি একসময় বাস্তবে রূপান্তরিত হয় বলেই পৃথিবী এবং মানুষ প্রগতির দিকে অগ্রসর হতে পারে।
মুক্তচিন্তার পথে সবচেয়ে বড় বাধা কী?
এককথায় প্রতিষ্ঠান। দেশের মধ্যে সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্র। আর পৃথিবীজুড়ে বৃহত্তম প্রতিষ্ঠান করপোরেট পুঁজিবাদ। প্রতিষ্ঠান ঠিক করে দেয় মানুষ কোন পথে চলবে, কীভাবে চিন্তা করবে, কীভাবে কোনো ঘটনায় প্রতিক্রিয়া জানাবে, বা আদৌ কোনো প্রতিক্রিয়া জানাবে কি না। রাষ্ট্র মানে শুধুমাত্র সরকার বা সরকারি দল নয়। বিরোধীদল, সামরিকবাহিনী, সিভিল সোসাইটি, পুলিশ, আমলাতন্ত্র, আইন-আদালত-জেলখানা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান এবং ধর্মীয় নেতা, গণমাধ্যমÑ ইত্যাদি সবকিছুর সমষ্টি।
প্রতিষ্ঠান কী চায়?
স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে চায়। তাহলেই সে নির্বিঘেœ মানুষের ওপর নিরব শোষণ এবং সরব অত্যাচার চালিয়ে যেতে পারে। শিক্ষাব্যবস্থা, আইন-আদালত, ধর্মীয় নেতৃত্ব, এবং গণমাধ্যম সেই স্থিতাবস্থার পক্ষে জনগণের সম্মতি উৎপাদন করে। কোনো সময় পরিবর্তনের দাবিতে জন-অসন্তোষ তৈরি হলে পরিবর্তনের বদলে কিছুটা সংস্কারের মাধ্যমেই জনগণকে শান্ত রাখার প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে। নাকের বদল নরুণ নিয়েই সন্তুষ্ট থাকো!
যে কোনো নতুন বৈপ্লবিক চিন্তাকে প্রতিহত করাই প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য। প্রতিষ্ঠান সর্বশক্তি নিয়োগ করে নতুন চিন্তাকে প্রতিহত করতে। তাকে অঙ্কুরেই বিনাশ করতে।
রাষ্ট্রের সন্ত্রাসী বা ঘাতক রূপটি আমাদের চোখে পড়ে। মামলা, হামলা, গুম-খুন, নির্বাসন আসে গণমাধ্যমে এবং সামাজিক মাধ্যমে। এইসব দেখে আমরা রাষ্ট্রের ফ্যাসিস্ট চরিত্রটি চিনতে শিখি। কিন্তু এগুলো হচ্ছে আইসবার্গের চ‚ড়ামাত্র। তার আটভাগের সাতভাগই আমরা দেখতে পাই না। সেই সাতভাগ হচ্ছে নিরব এবং অবিরাম কাজ করে যাওয়া ঘাতক। অনেক মারাত্মক, অনেক বিধ্বংসী।
মুক্তচিন্তার সংস্কৃতি-বিশ্লেষকরা সেই ঘাতকদের চিহ্নিত করে জানিয়েছেন, প্রচলিত বিশ্বাস ও সংস্কৃতিকে প্রচল রাখা এবং পরিপুষ্ট করার জন্য নিরলসভাবে নিরন্তর কাজ করে চলেছে তিনটি প্রধান হাতিয়ারÑ প্রতিষ্ঠানিক ধর্ম, তরল সাহিত্য ও গণমাধ্যম। মার্কিউস দেখিয়েছেন এই নিরব ঘাতকরা মানুষের বেশ কয়েকটি স্থায়ী ক্ষতিসাধন করে। যেমনÑ ১. ব্যক্তিগত এবং সামাজিক স্বার্থসমূহের মধ্যে এক ধরনের ভ্রান্ত বোঝাপড়া গড়ে তোলে। ২. ব্যক্তির চাই চাই খাই খাই ভাব ক্রমাগত বাড়িয়ে চলে। ৩. বিজ্ঞাপিত সৌন্দর্যের সামনে মানুষকে নতজানু করে। মানুষের নিজস্ব সৌন্দর্যবোধকে বিবশ করে দেয়। ৪. শ্রমজীবী মানুষকেও দেশজ সংস্কৃতিকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করতে শেখায়। ৫. যান্ত্রিক যুক্তিবিদ্যার তথা সরলীকরণের আধিপত্য বৃদ্ধি করে।
আরেক হাতিয়ার পণ্যায়ন। সবকিছুকে পণ্যে পরিণত করা। পণ্য। পণ্যমোহ এবং তার রহস্য। সেই চিরনির্বাসিত চিরবিদ্রোহী মানবমুক্তির প্রশ্নে আপসহীন মানুষটি, মানুষ যাকে মার্কস নামে চেনে, তার বাণী থেকে ঋণ না নিলে পণ্য নামক শব্দটি প্রহেলিকা হয়ে থাকেÑ ‘প্রথম দৃষ্টিতে পণ্যকে মনে হয় একটি তুচ্ছ বস্তু ও সহজেই বোধগম্য। কিন্তু বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় সেটি রহু অধিবিদ্যক নিগুঢ়তা ও ধর্মশাস্ত্রীয় সুক্ষèতার প্রাচুর্যে ভরা একটি অতি অদ্ভুত পদার্থ। যতদূর পর্যন্ত সেটি একটি ব্যবহার-মূল্য, ততদূর পর্যন্ত তার মধ্যে রহস্যময়তার কিছু নেই।… একথা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার যে মানুষ শ্রমদ্বারা প্রকৃতিদত্ত সামগ্রীর আকার এমনভাবে পরিবর্তিত করে, যাতে তাকে তার পক্ষে ব্যবহারযোগ্য করে তোলা যায়। যেমন, কাঠের রূপ পরিবর্তিত হয়ে টেবিল তৈরি হয়। তথাপি ঐ পরিবর্তন সত্তে¡ও টেবিল সেই সাধারণ প্রতিদিনের জিনিস, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য কাঠই থেকে যায়। কিন্তু যে মুহূর্তে তা পণ্যরূপে এক পা এগোয়, অমনি তার পরিণত হয়ে যায় অতীন্দ্রিয় একটা কিছুতে। তা কেবল জমির ওপরর পায়ে ভর দিয়েই দাঁড়ায় না, বরং অন্যান্য সকল পণ্যের সামনে মাথায় ভর দিয়ে দাঁড়ায়। তখন তার কাষ্ঠ-মস্তিষ্ক থেকে নির্গত হয় এমন সমস্ত কিম্ভূত-কিমাকার ধারণা, যা “টেবিলের নিজে নিজে নৃত্য করার” চেয়েও অনেক বেশি অদ্ভুত।’
পণ্য হতে না চাওয়া এবং মুক্তবাজারের নিয়মে প্রবেশ না করতে চাওয়ার দৃষ্টান্ত আমাদের দেশে এবং সাহিত্যে অনেক রয়েছে। জ্বলজ্বলে প্রমাণ তো লালন ফকির। তাঁর আগে-পরেও রয়েছেন অনেকে। এঁরা কিছুতেই প্রতিষ্ঠানের সিস্টেমের মধ্যে প্রবেশ করেননি। সিস্টেমকে অস্বীকার করেছেন। পণ্যায়িত হতে অস্বীকার করেছেন। সিস্টেমের বা ব্যবস্থার মধ্যে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে রাজি হননি। ইংরেজিশিক্ষিত লেখকদের মধ্যেও কেউ কেউ প্রতিষ্ঠানের বাইরে থেকেছেন। যেমন কমলকুমার মজুমদার। জীবৎকালে সেজন্য যে পরিমাণ গুনাগারি দেওয়া দরকার ছিল, তা তাঁরা দিয়েছেন। তাঁদেরকে জীবনযাপন করতে হয়েছে ভদ্রসমাজের কাছ থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে। ভদ্রসমাজও তাদের রেখেছে প্রান্তিক অবস্থানে, যাতে তাদের দ্বারা সংক্রমিত না হতে পারে বাজার-বিক্ষুব্ধ আর কেউ। কিন্তু আসল ট্রাজেডির শুরু তাঁদের মৃত্যুর পরে। মৃত্যুর পরে প্রতিষ্ঠান তাদের ঠিকই পণ্য বানিয়ে ছেড়েছে। এখন লালন বড় পণ্য, উকিল মুন্সি পণ্য, শাহ আবদুল করিম পণ্য। শতবর্ষী বিপ্লবী বিনোদবিহারীকেও ব্রান্ড অ্যাম্বাসাডর বানিয়ে ফেলেছে বিদেশি পুঁজি আর করপোরেট। সূর্য সেন, প্রীতিলতাও। আর মৃত্যুর পরে ‘অন্যধারার লেখক’ তকমা ঝুলিয়ে দিয়ে কমলকুমারকে বেচে দিব্যি পয়সা এবং গ্রহণযোগ্যতা কামিয়ে নিচ্ছে মুক্তবাজার। আর এইসব কদর্যতাকে হাততালি দিয়ে সাধুবাদ জানাতে হচ্ছে আমাদের। বলতে হচ্ছে, দেরিতে হলেও এগুলি আসলে তাঁদের যথাযোগ্য মূল্যায়ন।
০২.
মুক্তচিন্তার দৃশ্যমান বড় প্রতিবন্ধকতাগুলোর একটি হচ্ছে ধর্ম। ধর্মের সদর্থক দিকগুলোর কথা মাথায় রেখেও পর্যালোচকরা বলছেন, সামগ্রিকভাবে ধর্মের ভ‚মিকা এখন মানুষকে পেছনে টেনে রাখা বা রক্ষণশীলতা। মানুষ ধর্মের অনুশীলন বাদ দিয়ে উচ্চতর নৈতিক গুণাবলি অর্জন করতে পারে না বলে ধর্মনেতারা দাবি করলেও সেই দাবির সারবত্তা খুব বেশি নেই। ধর্ম ছাড়াও মানুষ উচ্চ নৈতিকতার অধিকারী হতে পারে। আমরা জওহরলাল নেহরুর কথা মনে করতে পারি। তিনি পার্থিব জগতের উন্নতিকে একমাত্র উন্নতি বলতে রাজি নন। বরং উন্নত সমাজ হবে এমন যাকে কিছু মাপকাঠি ধারণ করতে হয়। এগুলিকে নৈতিক মাপকাঠি বলা যেতে পারে। প্রতিটি ব্যক্তি ও সামাজিক গোষ্ঠীর জন্য এই মাপকাঠিগুলির প্রয়োজন। যদি এগুলির অস্তিত্ব না থাকে, তাহলে যাবতীয় পার্থিব উন্নতি সত্তে¡ও কোনো মঙ্গলজনক পরিস্থিতিতে পৌঁছানো সম্ভব হবে না। এগুলো ধর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন আত্মিক ও চারিত্রিক মাপকাঠি। নেহরু এই মাপকাঠিগুলির মধ্যে স্থান দিয়েছিলেন আত্মসম্মানবোধ , কর্মউদ্দীপনা, শিষ্টাচার, বদান্যতা, উন্নত মনোবৃত্তি, পরমতসহিষ্ণুতা, চারিত্রিক দৃঢ়তা, শ্রমের মূল্য ইত্যাদিকে।
বাংলাভাষায় ধর্ম ছাড়াই সংস্কৃতিবান হয়ে উঠতে পারা যে সম্ভব সে বিষয়ে সবচেয়ে পরিষ্কার আলোকপাত করেছেন গুরুত্বপূর্ণ লেখক-চিন্তক মোতাহের হোসেন চৌধুরী। সংস্কৃতিকে ধর্মের ওপরে, সংস্কৃতিবানকে ধার্মিকের ওপরে স্থান দিয়েছেন মোতাহের হোসেন চৌধুরী। প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের দিকে অভিযোগের তর্জনি তুলেছেন বিভিন্ন সময়ে। কেননা তাঁর মতে ধর্মের কর্মপরিধি সীমিত। ধর্ম চায় ‘মানুষকে পাপ থেকে, পতন থেকে রক্ষা করতে, বিকশিত করতে নয়। জীবনের গোলাপ ফোটানোর দিকে তার নজর নেই, বৃক্ষটিকে নিষ্কণ্টক রাখাই তার উদ্দেশ্য।’ প্রথাগত ধার্মিক হচ্ছে সেই ব্যক্তি, ‘আল্লাহ যার থাকে আকাশে।’ আর সেই ব্যক্তির দ্বারা যে কোনো অন্যায় ও নিষ্ঠুর কাজ হতে পারে। ‘আল্লাকে যে স্মরণ করে ইহলোকে মজাসে জীবন যাপন করার জন্য আর পরকালে দোজখের আজাব থেকে রক্ষা পাওয়ার উদ্দেশ্যে, অথবা স্বর্গে একটা প্রথম শ্রেণীর সিট রিজার্ভ করার আগ্রহেÑ অন্য কোন মহৎ উদ্দেশ্যে নয়। ইহকালে ও পরকালে সর্বত্রই একটা ইতর লোভ।’
প্রথাগত ধর্ম মোতাহের হোসেন চৌধুরীর কাছে অভিযোগের কাঠগড়ায় দাঁড়ায় আরও বেশ কিছু কারণে। যেমন তাঁর একই প্রবন্ধে বলা হচ্ছেÑ ‘চিন্তা বা বিশ্বাসের ব্যাপারে সমতা স্থাপন করে মানুষের স্বাতন্ত্র্য লুপ্ত করতে চায় বলে ধর্ম অনেক সময়ে কালচারের পরিপন্থী।’ ধার্মিকের কাছে আল্লার হুকুম আর বেহেস্ত-দোজখই বড় হয়ে ওঠে, সূ² অনুভূতির কথা নয়। অপর পক্ষে ‘কালচার্ড’ বা সংস্কৃতিবান ব্যক্তি এই সমস্ত ত্রæটি থেকে নিজেকে রক্ষার জন্য সংস্কৃতিকেই নিজের বর্ম বানিয়ে রাখেন। মোতাহের হোসেন চৌধুরীর ভাষায়Ñ ‘শকুনের মতো সে মরা গরুর সন্ধানে থাকে না, বুলবুলের মতো তার দৃষ্টি থাকে গোলাপকুঞ্জের দিকে। লোকটির মনে সৌন্দর্য্য ও প্রেমের পরিচয় পাওয়া যায় কি না, তার বুকে মানুষ ও মনুষ্যত্বের জন্য সজীব দরদ আছে কি না, নিষ্ঠুরতাকে সে মনে-প্রাণে ঘৃণা করে কি না, তা-ই সে দেখতে চায়, এবং দেখতে পেলে খুশী হয়ে সাত খুন মাফ করে দেয়। কেননা, সে জানে প্রেম ও সৌন্দর্য্যরে পূজারীদের জীবনে এখানে-সেখানে স্খলন-পতন থাকলেও যাকে বলা হয় ব্যাভিচার, তা কখনো থাকতে পারে না। লোভ ও লালসার হাতে ক্রীড়ণক হতে চায় না বলে তারা সর্বদা পবিত্র।’
রেনেসাঁ বা পুনর্জাগরণের সঙ্গে সঙ্গেই ধর্ম, আত্মা, প্রকৃতি, ঈশ্বরবিষয়ক প্রশ্নগুলি পুনর্বিবেচনার জন্য পুরোপুরি তীক্ষèতার সঙ্গে উত্থাপিত হলো। উত্থাপিত হলো আরও কিছু প্রশ্ন। যেমন চিন্তার সঙ্গে সত্তার সম্পর্ক কী, চৈতন্য আর সত্তার মধ্যে কোনটি আদি, ঈশ্বর কি জগৎ সৃষ্টি করেছেন না কি চিরকালই জগতের অস্তিত্ব ছিল?
কলকাতাকে কেন্দ্র করে সংঘটিত খÐিত রেনেসাঁ এইসব মৌলিক প্রশ্নের কাছে যাওয়ার সাহস সঞ্চয় করে উঠতে পারেনি। তবে ধর্মের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ, জবরদস্তিমূলক প্রথা-শরিয়ত, ধর্মের সামাজিক ভূমিকা, বিভিন্ন ধর্মীয় চিন্তা ও প্রথার পুনর্নবায়নÑ ইত্যাদি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে ঠিকই। রামমোহন, বিদ্যাসাগর, ডিরোজিও-সহ ইয়ং বেঙ্গল গোষ্ঠী কাজ করেছেন কলকাতায়। একশো বছরেরও বেশি সময় পরে বাঙালি মুসলমান সমাজে রেনেসাঁর অঙ্কুরোদ্গম হয়েছিল। ১৯৪৬ সালে ঢাকার মুসলিম সাহিত্য সমাজ নিজেদের ধর্মের পুনর্মূল্যায়নের কাজে ব্রতী হয়েছিল। আবুল হুসেন, কাজী আবদুল ওদুদ, মোতাহের হোসেন চৌধুরী, কাজী মোতাহার হোসেন, আব্দুল কাদির, আবুল ফজলসহ কয়েকজন যুবক-তরুণ ভাবুক ছিলেন এই সংগঠনে। তাদের মুখপত্র ছিল ‘শিখা’। এই গোষ্ঠীকে এখন ‘শিখাগোষ্ঠী’ নামেই চেনে মানুষ। বাঙালি মুসলমান সমাজে দলবদ্ধভাবে মুক্তবুদ্ধি এবং মুক্তচিন্তা চর্চার এটাই প্রথম এবং একমাত্র প্রয়াস। ঢাকার নবাববাড়িতে ধর্মনেতারা ঢাকার হর্তা-কর্তা-বিধাতা নবাবের হুকুম জারির মাধ্যমে বিচারসভা বসিয়ে এই সংগঠনকে অচিরেই বিলুপ্ত করতে বাধ্য করে। আবুল হুসেনকে নিঃশর্ত ক্ষমা চাইতে বাধ্য করা হয়, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের প্রভাষকের চাকুরি থেকে তাকে পদত্যাগ করতে হয়, এমনকি আক্ষরিক অর্থেই নাকে খত দিতে বাধ্য করা হয়।
অবস্থা এখন আরো বেশিই প্রতিক‚ল। অন্ধকারে ঘাতক লেলিয়ে দেওয়ার পর্যায়ে পৌঁছেছে। আত্মাহুতি দিতে হচ্ছে, দেশত্যাগ করতে হচ্ছে মুক্তচিন্তার মানুষদের।
রাষ্ট্রের ভ‚মিকা এখানে মুক্তচিন্তার পক্ষে বিন্দুমাত্র সহায়ক নয়। রাষ্ট্র নামক প্রতিষ্ঠান যে মুক্তচিন্তা পছন্দ করে না, তা এই একবিংশ শতকেও নানারকম কালাকানুন প্রণয়ন করে বুঝিয়ে দিচ্ছে প্রতিনিয়ত।
০৩.
বিপরীত অবস্থা বা প্রতিরোধের চেহারাটি কেমন?
মুক্তচিন্তা একটি সার্বিক ব্যাপার। কিন্তু সেটিকে খÐ খÐ করে ফেলা হয়েছে এনজিও-পদ্ধতিতে উত্তরআধুনিক যুগে। নারীবাদী মুক্তচিন্তা, পরিবেশবাদী মুক্তচিন্তা, ধর্মের সমালোচনামূলক মুক্তচিন্তা, স্বাধীনভাবে লেখা-বলার মুক্তচিন্তা, মৌলবাদবিরোধী মুক্তচিন্তা, আদিবাসী সম্পর্কিত মুক্তচিন্তা, সংখ্যালঘু বিষয়ক মুক্তচিন্তা, নারীর পোশাক বিষয়ক মুক্তচিন্তা, দাম্পত্য সম্পর্কের মুক্তচিন্তা, বিজ্ঞানের সত্য প্রকাশের দাবিতে মুক্তচিন্তা, মতামত প্রকাশের মুক্তচিন্তা, সমকামিতা বিষয়ক মুক্তচিন্তা, যৌনতা বিষয়ক মুক্তচিন্তাÑ আরো অসংখ্য খÐ শিরোনাম। এনজিও-রা যখন যে বিষয়ে বিদেশি টাকা বা অনুদান পায়, সেই বিষয়কেই জাতির মুক্তির একমাত্র উপায় বলে ঘোষণা করে। কিন্তু একটি বিষয়কে নিয়ে এগুতে চাইলে, কিছুটা এগুতে পারলেও পিছিয়ে থাকা অন্য বিষয়গুলি যে তাকে আবার টেনে নিজেদের অবস্থানেই নিয়ে আসে, আত্মতুষ্ট এনজিওদের মতো খোপে খোপে বিভক্ত মুক্তচিন্তকরা সেটি বুঝতে পারেন না। সবগুলো কর্মসূচি চলে নিজের নিজের পথ ধরে। একটির সাথে আরেকটির সমন্বয় নেই। ফলে মুক্তচিন্তা-আন্দোলন কোনো সর্বজনীন রূপ বা অবয়ব পাচ্ছে না। যেখানে সময়ের দাবি হচ্ছে সমন্বয়, সেখানে বিচ্ছিন্নতাই দুঃখজনক বাস্তবতা। এই বিচ্ছিন্নতার অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে সার্বিকভাবে গ্রহণযোগ্য একটি দর্শনের অভাব। সার্বিক মুক্তির একটি দর্শনই কেবল পারে মুক্তচিন্তার সবগুলো ধারাকে এক মোহনায় মিলিত করতে। মার্কসবাদ ছিল সেই দর্শন। ‘ছিল’ বলছি কারণ এখন সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পরে অনেকের কাছেই মার্কসবাদ প্রশ্নবিদ্ধ। আবার এ পর্যন্ত পৃথিবীতে মানবজাতির সার্বিক মুক্তির কোনো বিকল্প দর্শনও প্রস্তাবিত হয়নি। তবে মানবমুক্তিকামী চিন্তকরা বসে নেই। তাঁরা গবেষণা করছেন, পর্যালোচনা করছেন, ভাবছেন বিকল্প বিশ্বব্যবস্থার কথা। ততদিন পর্যন্ত হাত গুটিয়ে বসে থাকা তো কোনো কাজের কথা নয়। চলুক মুক্তচিন্তার সংগ্রাম।