স্টাফ রিপোর্টার
নাটোরের লালপুরে থানা হেফাজতে আসামিদের নির্যাতনের অভিযোগে একজন অতিরিক্ত পুলিশ সুপারসহ পাঁচ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের জন্য পুলিশ সুপারকে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। বৃহস্পতিবার সন্ধায় লালপুর আমলি আদালতের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো. মোসলেম উদ্দীন এই নির্দেশ দেন। আদালতের নির্দেশনা বাস্তবায়ন করা হয়েছে কি না, তা নিশ্চিত করার জন্য ১৫ জুলাইয়ের মধ্যে আদালতে প্রতিবেদন জমা দেওয়ারও আদেশ দেন তিনি । এর আগে কাঠগড়ায় আসামীরা তাদের পুলিশ হেফাজতে নির্যাতনের অভিযোগ করেন। অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যরা হলেন বড়াইগ্রাম সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শরীফ আল রাজিব, লালপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. উজ্জ্বল হোসেন, উপপরিদর্শক (এসআই) জাহিদ হাসান, ওমর ফারুক ও এক কনস্টেবল।তবে এ অভিযোগ অস্বীকার করে লালপুর থানার ওসি ওসি উজ্জ্বল হোসেন বলেন, থানায় আসামি নির্যাতনের কোনো ঘটনা ঘটেনি।
আদালত সূত্রে জানা গেছে, লালপুর থানা-পুলিশ অটোরিকশা ছিনতাই মামলায় পাবনার ঈশ্বরদীর ফতেহ মোহাম্মদপুর গ্রামের মো. সোহাগ (৩০), মোকাররমপুর গ্রামের মো. সালাম (৩১), নাটোরের বড়ইগ্রামের নগর গ্রামের মো. শামীম মোল্লা (২৯) ও কুষ্টিয়া সদর উপজেলার বারাদি গ্রামের মো. রাকিবুল ইসলামকে (৩০) গ্রেপ্তার করে। বুধবার তাঁদের লালপুর আমলি আদালতে হাজির করা হয়। আসামিরা আদালতের কাছে দেওয়া জবানবন্দিতে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের অভিযোগ করেন।
আদালতের বেঞ্চ সহকারী আবদুল্লাহ বিশ্বাস বলেন, আসামিদের মধ্যে সোহাগ হোসেনের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি রেকর্ড করার জন্য আবেদন করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই ওমর ফারুক। তিনি অন্য আসামিদের জেলহাজতে পাঠানোর জন্য উপস্থাপন করেন। এ সময় চার আসামির মধ্যে রাকিবুল ইসলাম বাদে তিনজনই থানায় পুলিশি হেফাজতে নির্যাতনের অভিযোগ করেন।
সোহাগ হোসেন আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে উল্লেখ করেন, ৯ জুলাই (রোববার) রাত পৌনে ৯টার দিকে উত্তর লালপুর গ্রামে শ্বশুরবাড়ি থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। থানায় আসার পরপরই ওসি উজ্জ্বল হোসেন তাঁকে চোখ বেঁধে মারধর শুরু করেন। তারপর ১১ জুলাই থানা-হেফাজতে থাকাকালীন ওসি তাঁর পায়ের তালুতে লাঠি দিয়ে মারেন এবং অণ্ডকোষে লাথি দেন। এরপর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শরিফ আল রাজিব তাঁকে বলেন, যদি ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে দোষ স্বীকার না করেন, তাহলে ওখান থেকে তাঁকে রিমান্ডে নেবেন। তারপর এমন মামলা দেবেন যাতে আর কোনো দিন বউ-বাচ্চার মুখ দেখতে না পারেন।
অপর আসামি মো. সালাম তাঁর জবানবন্দিতে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে অভিযোগ করেন, পুলিশ তাঁকে ৯ জুলাই রাত ১টার দিকে তাঁর বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তারের পর তাঁকে বিভিন্ন জায়গায় ঘোরানোর পর ভোর পাঁচটার দিকে থানায় নিয়ে আসে। সেদিন তাঁকে মারধর করেনি। পরদিন ১০ জুলাই ওসি থানায় ঢুকেই থাপ্পড় মারতে থাকেন। তারপর থানার ওপর তলায় নিয়ে এসআই জাহিদ হাসান ও তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই ওমর ফারুক তাঁর কনিষ্ঠ আঙুলের ওপরে টেবিলের পায়া রেখে চাপ দিতে থাকেন। এতে সেলিমের কনিষ্ঠ আঙুলের ওপরে, মধ্যমা আঙুল ও অনামিকা আঙুলে মারাত্মকভাবে ক্ষত হয়। তারপর বাঁ পায়ে লাঠি দিয়ে আঘাত করেন। ১২ জুলাই আবার তাঁকে পেটানো হয়।
আরেক আসামি শামীম মোল্লাও অভিযোগ করেন, পুলিশ তাঁকে ১০ জুলাই রাত সাড়ে তিনটার দিকে বাড়ি থেকে তুলে নেয়। তারপর রাস্তায় মারতে মারতে থানায় নিয়ে আসে। ১১ জুলাই সকালে থানার ওপর তলায় নিয়ে গিয়ে একজন কনস্টেবল, এসআই জাহিদ হাসান ও তদন্তকারী কর্মকর্তা ওমর ফারুক চোখ বেঁধে টেবিলের নিচে তাঁর মাথা রেখে মোটা বাঁশের লাঠি দিয়ে প্রচন্ড রকমের মারপিট করেন। তারপর দুই পা বেঁধে পায়ের তালুতে পেটায় ও বুকে বারবার লাথি দিতে থাকে।
আদালত সূত্রে জানা গেছে, আসামিদের বক্তব্য ও শরীরে আঘাতের চিহ্ন পর্যালোচনা করে স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য নাটোরের জেল সুপার ও আধুনিক সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ককে নির্দেশ দেন। আসামিদের শরীরে থাকা জখমের কারণ এবং জখমের সুনির্দিষ্ট বর্ণনা দিয়ে মেডিকেল সার্টিফিকেট প্রস্তুত করে বৃহস্পতিবার বিকেল চারটার মধ্যে আদালতে উপস্থাপন করার নির্দেশ দেন আদালত। নাটোর সদর হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক মো. সামিউল ইসলাম গতকাল আদালতে সেই প্রতিবেদন দেন।
চিকিৎসকের দেওয়া প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে অভিযোগকারী তিন আসামির মধ্যে মো. সালাম এবং মো. শামীম মোল্লার শরীরে নির্যাতনের প্রাথমিক সত্যতা পান আদালত। অপর আসামি সোহাগের শরীরে দৃশ্যমান আঘাতের চিহ্ন নেই বলে চিকিৎসক প্রতিবেদন দিয়েছেন।
এ বিষয়ে নাটোরের পুলিশ সুপার মো. সাইফুর রহমান বলেন, গ্রেপ্তারকৃত আসামীরা পেশাদার অটো ছিনতাইকারী। তাদের বিরুদ্ধে পাবনায় ৫টি চিনতাই মামলা রয়েছে। এছাড়া অভিযুক্তদের নিকট থেকে দুটি ছিনতাইকৃত অটো উদ্ধার করা হয়েছে। অটোরিকশা ছিনতাই মামলার আসামিদের ধরার সময় তাঁরা দৌড়ে পালাতে গেলে পড়ে গিয়ে শরীরের কেথাও আঘাত লাগতে পারে। কিন্তু অভিযোগ থেকে বাঁচতে তারা পুলিশি নির্যাতনের অভিযোগ করেছে। তিনি বলেন এ সংক্রান্ত নির্দেশ তিনি এখনো হাতে পাননি। আদেশের কপি পেলে তদন্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।