স্টাফ রিপোর্টার
নাটোরে দুটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভবন নির্মাণ কাজ পুরোপুরি শেষ না হতেই এককোটি ৪১ লাখ ৬৫ হাজার টাকা প্রদান করেছে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর। অভিযোগ উঠেছে, এই অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের যোগসাজশে কাজ অসমাপ্ত থাকার পরও ৯০ভাগ টাকা প্রদান করা হয়েছে। এক বছরে সকল কাজ শেষ করার কথা থাকলে তা শেষ হয়নি চার বছরেও। ঘটনা জানাজানি হওয়ায় সেই কাজ তড়িঘড়ি করে শেষ করতে গিয়ে কাজের মান খারাপ হবারও অভিযোগ উঠেছে।
সরজমিনে নাটোরের লালপুর উপজেলার বিলমাড়িয়া দাখিল মাদ্রাসায় গিয়ে দেখা যায় চিরচেনা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কলরব নেই এখানে। সুনসান নীরবতায় ঘেরা প্রতিষ্ঠানটিতে নেই শিক্ষক, শিক্ষার্থী এমনকি একটি সাইনবোর্ডও। কয়েকজন রাজমিস্ত্রী নির্মাণাধীন ভবনের প্লাস্টারের কাজ করছেন । একপাশে চলছে টয়লেট নির্মাণের কাজ। পাশের টিনশেড মাদরাসাটির একটি ঘরে ভবনের চালা নেই। অপর একটি ছোট টিনশেড ঘর তালাবদ্ধ। সুমন আলী ও মনিরুল ইসলাম নামে দুইজন স্থানীয় বাসিন্দা জানান, এক সময় এই মাদরাসাটির থেকে আড়াইশ ছাত্র নিয়মিত ক্লাশ করতো। দীর্ঘদিন ধরে বিদ্যালয়টি এমপিও ভুক্ত হয়নি। বলেন ২০২১ সালে নির্মাণ কাজ শুরু হওয়ার পরে টিনশেড ঘরটির চালা ঝড়ে উড়ে যায়। এরপর ছোট ঘরটিতে ব্রেঞ্চ টেবিল চেয়ার ডাই করে রাখার জন্য ক্লাস রুমের অভাবে মাদরাসাটি বন্ধ হয়ে যায়। আশা ছিল অল্প দিনের মধ্যে নতুন ভবন নির্মাণ হলে মাদরাটির ক্লাস শুরু হবে। কিন্তু দীর্ঘ ৪ বছরেও কাজ শেষ না হওয়ায় আমাদের মাদরাটি বন্ধই রয়েছে। কাজের মান ভাল নয়।
শিক্ষা প্রকৌশল নাটোর অধিদপ্তর সুত্রে জানা যায়, ২০২১ সালের জুন মাসে এখানে ভবন নির্মাণে বরাদ্দ হয় ৭৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা। মাদ্রাসাটির ভবন নির্মাণের কার্যাদেশ পায় যশোরের ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান মেসার্স আব্দুল মান্নান।৯মাসের মধ্যে প্রকল্পটির কাজ শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু ৪ বছরেওরেও নির্মাণ কাজ শেষ হয়নি।
অথচ ৩০ শতাংশ কাজ বাকি থাকলেও ২০২৩ সালের ২১ জুন ঐ কাজের জন্য ৭০ লাখ টাকা প্রদান করা হয় ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানটিকে। এরপর চলমান কাজ বন্ধ রাখে ঠিকাদার। ঘটনা জানাজানি হওয়ায় সম্প্রতি তরিঘরি করে অসমাপ্ত কাজগুলো করা হচ্ছে। এ নিয়ে তেমন সদুত্তর নেই উপ-সহকারী প্রকৌশলীর কাছে। ইউপি চেয়ারম্যান সিদ্দিকুর রহমান মিষ্টু বলেন, মাদরাসাটির কাজ সময়মত না হওয়া খুব দুঃখ জনক ঘটনা।একারণে বিলমারিয়া দাখিল মাদরাসার অনেক ক্ষতি হয়েছে।
এ বিষয়ে লালপুরের শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের উপ-সহকারী প্রকৌশলী, সেলিম রেজা জানান, ঠিকাদার যতটুকু কাজ করেছেন সে ই অনুপাতে বিল দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ভবনের দরজা জানালা প্লাস্টার ও টয়লেটের কাজ শেষ না করেই কিভাবে তাকে ৯০ ভাগ বিল প্রদান করা হয়েছে সে বিষয়ে সদুত্তর দিতে পারেননি তিনি।
একই চিত্র নাটোরের সদর উপজেলার বারঘরিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে। ভবন নির্মাণকাজের জন্য ২০২২ সালের মার্চ মাসে ৮৫ লাখ টাকা ব্যয়ে ভবন নির্মাণের কার্যাদেশ পায় নাটোরের মেসার্স সিফাত এন্টার প্রাইজ। এখানে ৪৫ শতাংশ কাজ বাকি থাকলেও একই সময়ে (২০২৩ সালের ২১ জুন) ৭১ লাখ ৬৫ হাজার টাকা বিল নিয়ে ঠিকাদার কাজ বন্ধ রাখে। সম্প্রতি দিনরাত একাকার করে কাজ করা হচ্ছে। মরজিমেন দেখা যায়, বিল্ডিংয়ের ঢালাই , প্লাস্টার, রং, দরজা জানালা তৈরির জন্য কাঠমিস্ত্রিী,ইরেকটিক মিস্ত্রিী, এবং টাইলস্ মিস্ত্রী এক সংগে কাজ করছেন। ঢালাইয়ের ব্যহৃত পানিতে কর্দমাক্ত উচ্চ বিদ্যালয়ের ভিতরের মাঠ। এর মধ্যে শিক্ষার্থরা কষ্ট করে ক্লাস করছেন। বারোঘরিয়া উচ্চ বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির আহবায়ক সোহেল মাহমুদ বলেন,কাজের মান খুব নিম্ন মানের। আমরা প্রতিবাদ করেও কোন প্রতিকার পাচ্ছি না। তাছাড়া এত গুলো কাজ এক সাথে করার জন্য কাজের মানআরো খারাপ হচ্ছে। ভেজা প্লাস্টারের উপর রং করায় এ রং টিকসই হবে না।তিনি বলেন ইচ্চ পর্যায়ের একটি কদন্ত টিম বিদ্যালয় পরিদর্শনে আসবে । একারণে তড়িঘড়ি করে কাজ শেষ করা চেষ্টা করছেন। প্রধান শিক্ষক সাজেদা খাতুন বলেন নিম্ন মানের ইট দিয়ে কাজ শুরু করলে আমি বাধা দেওয়ায় সেগুলো ফিরিয়ে নিবে বলে ঠিকাদার জানিয়েছেন। তিনি বলেন কাজ বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরে আমি বিভিন্ন সময়ে তাগাদা দিয়েও কাজ শুরু করাতে পারিনি। হঠাৎ করে গত কয়েকদিন দন আগে দেখি ঠিকাদার মিজানুর রহমান লট বহর নিয়ে হাজির ।
এ বিষয়ে বিলমাড়িয়া দাখিল মাদ্রাসার সাব ঠিকাদার ও বারঘরিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের মুল ঠিকাদার মিজানুর রহমান জানান, বরাদ্দ না থাকায় কাজ বন্ধ রাখা হয়েছিল। নতুন করে বরাদ্দ পাবার পর এখন বাকি কাজ করা হচ্ছে।
কাজ শেষ না করেই তৎকালীন নাটোর শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের সাবেক নির্বাহী প্রকৌশলী এবং বর্তমান প্রধান কার্যালয়ের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী-২ মো. আসাদুজ্জামান বলেন , যতটুকু কাজ হয়েছে অতটুকই বিল প্রদান করা হয়েছে। কোন অনিয়ম করা হয়নি।
তবে বর্তমান শিক্ষা প্রকৌশল নাটোরের নির্বাহী প্রকৌশলী মাতোয়ারা পারভীন ঠিকাদারদের গাফিলতি অকপটে স্বীকার করে জানান, অঅগস্ট াবপ্লবের পরে অনেক ঠিকাদার ঠিকমত কাজ করতে না পারায় অনেক কাজে বিলম্ব হয়েছে। তিনি দায়িত্ব পাওয়ার পর বন্ধ থাকা কাজ বুঝে নেবার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন।
জানা যায়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভবন নির্মাণে অনিয়মের অভিযোগে গত ২৩ অক্টোবর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ মো. আসাদুজ্জামানসহ মোট পাঁচজন প্রকৌশলী ও ১১জন ঠিকাদারের অনিয়ম-দুর্নীতি তদন্ত করতে ইইডির প্রধান প্রকৌশলীকে চিঠি দেয়। চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে একটি তদন্ত কমিটিও গঠন করেছে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর। তদন্ত কমিটি ঘটনাস্থল পরিদর্শনের পুর্বেই তড়িঘরি করে কাজ শেষ করার চেষ্টা করছেন ঠিকাদার।
নাটোরে দুটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভবন নির্মাণে অনিয়ম, কাজ শেষ না করেই হরিলুট!#সংবাদ শৈলী 