স্টাফ রিপোর্টার
নাটোরের সিংড়ার সোহেল রানা ঢাকার বাইপাইলে পোশাক কারখানায় কাজ করতেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। মা–বাবা–ভাই তাঁর সেই করুণ মৃত্যুর কথা শোনান। শুক্রবার সকালে উপজেলার শোয়াইড় বালানপাড়া এলাকায় বাড়ির আঙিনায়। মা রেহেনা বেগম আবেগে আপ্লুত হয়ে অস্রু সজল ব্যাথা কৃত হৃদয়ে বলেন “আমার ছেলে ছোটবেলা থেকেই সংসারী। ডিপ্লোমা পাস করে সাত বছর ধরে ঢাকায় চাকরি করত। সর্বশেষ রোজার ঈদে বাড়িতে আইছিল। বাপ-ভাইয়ের সাথে নামাজ পড়ি সারা পাড়া ঘুরিছিল। নিজে হাতে ছ্যালিকে সেমাই-রুটি খাওয়াইছি। বাড়তি ইনকামের জন্য কোরবানির ঈদে বাড়িতে আসেনি। ১০ আগস্ট আসার কথা ছিল। ৫ আগস্ট বেলা ১১টায় ফোনে সোহেলের সাথে কথা হয়। ওই সময় আমাকে বলছিল “মা এখানে খুব গ্যাঞ্জাম হচ্ছে। শুনলাম নাটোরেও হচ্ছে। তোমরা সাবধানে থেকো।” অথচ ওই দিনই গ্যাঞ্জামের গুলি আসি লাগে আমার বেটার পেটে। অনেকক্ষণ চিকিৎসা পায়নি। পরে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর পরই মারা যায়। পরের দিন ওর লাশ আসে বাড়িতে” মা এখানে খুব গ্যাঞ্জাম হচ্ছে। শুনলাম নাটোরেও হচ্ছে। তোমরা সাবধানে থেকো।’ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান চলাকালে গত ৫ আগস্ট বেলা ১১টার দিকে মুঠোফোনে মাকে এসব কথা বলেন সোহেল রানা (২৬)। এর সাত ঘণ্টা পর ঢাকার বাইপাইলে নিজের ভাড়া বাসার চারতলার জানালার পাশে দাঁড়ানো অবস্থায় গুলি এসে লাগে তাঁর পেটে। বিভিন্ন হাসপাতাল ঘুরে এনাম মেডিকেলে ভর্তি হওয়ার পর রাত ৯টার দিকে সোহেলের মৃত্যু হয়। সোহেল রানা নাটোরের সিংড়া উপজেলার শোয়াইড় বালানপাড়ার মতলেব আলী-রেহেনা বেগম দম্পতির ছেলে। তিনি ঢাকার বাইপাইলে একটি পোশাক কারখানায় সুপারভাইজার পদে চাকরি করতেন। বাইপাইল থানার বিপরীত পাশের একটি বাসার চারতলায় ভাড়া থাকতেন তিনি। সোহেল অবিবাহিত ছিলেন। মা–বাবা ও তিন ভাই-বোনের সংসারে উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন তিনি। তাঁর প্রতি মাসে পাঠানো ১০ হাজার টাকায় সংসার চলত। শুক্রবার সকালে সোহেলের বাড়িতে গিয়ে কথা হয়, তাঁর মা–বাবা ও বড় ভাইয়ের সঙ্গে। বাবা মতলেব আলী বলেন, ছোট বোনের বিয়ে না হওয়ায় তাঁর ছেলে বিয়ে করেননি। তাঁর বিয়ের জন্য খরচ জোগাড় করছিলেন। অথচ অসময়ে চলে গেল নিজেই। তাঁর কোনো সাধই মিটল না। তিনি বলেন, ‘এ কষ্ট আমি কাউকে বোঝাতে পারব না। তবে ওরা জান দিয়া দেশটাকে বাঁচাইছে। এডায় সান্ত্বনা। দেশডা ভালোভাবে চললে ওর জানডা শান্তি পাবি। সোহেলের বড় ভাই আব্দুল্লাহ বলেন, ‘আমাদের দুই ভাইয়ের মধ্যে খুব মিল ছিল। দিনে অন্তত তিনবার মোবাইলে কথা বলত। ওই দিনও বলেছিল, ভাই আমার বাসাডা বদলাতে হবি। খুব গ্যাঞ্জাম হচ্ছে। পুলিশ থানার সামনে থ্যাকি গুলি করছে। আমার বাসা উল্টো দিকে হওয়ায় যেকোনো সময় গুলি আসতে পারে। তবে চারতলায় হয়তো গুলি আসবে না। কিন্তু ভাইয়ের এই ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়ছে। ওই দিন সন্ধ্যা ৬টার দিকে জানালার ধারে দাঁড়ায়ে ছিল। হঠাৎ গুলি এসে পেটে ঢুকে পড়ে। আমার ভাই আহত হওয়ার পর দীর্ঘ সময় চিকিৎসা পায়নি। এটায় আমাদের দুঃখ। তবে বাইপাইলে বসবাসকারী আমার চাচা জাহিদ হোসেন, ওর বন্ধু রাসেল ও আমার এক চাচাতো বোন ওকে চিকিৎসা দেওয়ার জন্য খুব চেষ্টা করেছে।’ বাইপাইলে বসবাসরত চাচা জাহিদ হোসেন বলেন, ‘আমার ভাতিজা আন্দোলনের মিছিলে গিয়ে মরেনি। কিন্তু আন্দোলনের কারণে পুলিশের ছোড়া গুলিতে তার মৃত্যু হয়েছে। তার মতো অনেকের মৃত্যুর কারণেই হাসিনা বেসামাল হয়ে পড়িছিল। অবশেষে দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়ছে। আমরা নতুন স্বাধীনতা পাইছি। এটাই আমাদের অনেক বড় পাওয়া। সব শহীদের জন্য আমরা দোয়া করি। আল্লাহ যেন ওদেরকে শান্তিতে রাখে।’