লন্ডনে পাঠানোর কথা বলে প্রতিবন্ধী নারীর ৫ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ

  • মঙ্গলবার, ৭ নভেম্বর, ২০২৩
লন্ডনে পাঠানোর কথা বলে প্রতিবন্ধী নারীর ৫ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ#সংবাদ শৈলী
প্রতিবন্ধী জুলেখা বেগম। লন্ডনে পাঠানোরকথা বলে ৯৭ জন লোকেরকাছ থেকে প্নিরতারনা করে নিয়েছেন ৫কোটি টোকা।

স্টাফ রিপোর্টার
নাটোরের সদর উপজেলার বারঘরিয়া গ্রামের প্রতিবন্ধী নারী জুলেখা আক্তার জুলি। দুই পায়ে সমস্যা হওয়ায় চলাফেরা করেন হুইল চেয়ারে। একটি প্রতিবন্ধী সংস্থার মাধ্যমে জুলেখা ইংল্যান্ড ভ্রমণ করেছেন দুইবার।এরপর থেকে জুলেখা এলাকায় প্রচার করতে থাকেন তার পরিচিত কোম্পানিতে ‘মেডিকেল কেয়ার ওয়ার্কার হিসেবে লোক পাঠানোর সুযোগ রয়েছে। একাজটি তিনি পাইয়ে দিতে পারেন। কিন্তু তার জন্য লাগবে ১৮ লাখ টাকা। এর ,মধ্যে প্রথমে ৫ লাখ টাকা জুলেখার কাছে জমা দিতে হবে আর বাকি টাকা দিতে হবে লন্ডনে যাওয়ার পরে। লন্ডনে সেই কাজের জন্য শ্রমিকদের প্রয়োজন নেই লেখা পড়া জানার। জুলেখা ও এই চক্রের এমন প্রচারণায় তৈরি ফাঁদে পা দিয়ে অটোরিক্সা চালক থেকে শুরু করে শিক্ষিত তরুণরাও হয়েছেন সর্বশান্ত।

অভিযোগ উঠেছে নাটোর ও রাজশাহী জেলার ৫০ ব্যক্তি সহ সারাদেশের ৯৭জন মানুষকে লন্ডনে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে তাদের থেকে প্রায় ৫ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন প্রতিবন্ধী জুলেখা আক্তার জুলি ও তার চক্র। ভুক্তভোগীদের অভিযোগে এ চক্রের ৩ সদস্যকে গ্রেপ্তারও করেছে পুলিশ। তবে এখনো ধোঁরা ছোঁয়ার বাইরে রয়েছেন চক্রের মাস্টারমাইন্ড জুলেখা আক্তার।

ভুক্তভোগীদের অভিযোগ- টাকা দেওয়ার পর সবাইকে একসঙ্গে ঢাকায় নিয়ে যায় চক্রটি। সেখানে ফ্লাইটের তারিখ বলে আর কোনো খোঁজখবর না নিয়ে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয় তারা। প্রতারিত হয়েছেন বুঝতে পেরে ভুক্তভোগীরা গ্রামে এসে টাকা ফেরত চাইলে কালক্ষেপণ করতে থাকেন জুলেখা। পরে স্থানীয় গ্রাম প্রধানদের শালিশেও হয়না এর সুরাহা।

এদিকে লন্ডনে যাওয়ার জন্য ব্যাংক লোন, সুদের টাকা, ধারদেনা ও শেষ সম্বল অটোরিক্সা বেঁচে টাকা দেওয়া ভুক্তভোগী পরিবারগুলোর ঋণের বোঝা বাড়ছে চক্রবৃদ্ধি হারে। অনেকে ঋণের ফাঁদে আটকে স্ত্রী- সন্তান ছেড়ে থাকছেন পালিয়ে পালিয়ে।

প্রতারণার শিকার সদর উপজেলার কাফুরিয়া পন্মাতপুর গ্রামের সাইফুল ইসলামের স্ত্রী সাথী আক্তার বলেন, আমার স্বামীকে লন্ডন নিয়ে যাওয়ার কথা বলে প্রতিবন্ধী জুলেখা। এর জন্য তাকে ৫ লাখ টাকা দিতে হবে বলে জানায়। পরে ২ লাখ টাকা লিজের ওপর(সুদ) ও ২লাখ টাকা কিস্তি তুলে মোট ৫ লাখ টাকা গুছিয়ে তাকে দেই। এরপর লন্ডন নিয়ে যাওয়ার কথা বলে ঢাকায় নিয়ে আরও ৪০ হাজার টাকা খরচ করিয়ে আমার স্বামীকে বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়। তিনি বলেন, লিজ ও কিস্তর টাকা পরিশোধ করতে না পেরে আমার স্বামী পালিয়ে বেড়াচ্ছে। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, খুব কষ্টে দিনপার করছি। সন্তানদের নিয়ে খেয়ে না খেয়ে দিন কাটছে। আমরা এর বিচার চাই।
বাগাতিপাড়া উপজেলার জামনগর গ্রামের ভুক্তভোগী রনি ইসলাম বলেন, কেয়ার ভিসায় লন্ডনে নিয়ে গিয়ে মাসে ৩ লক্ষ টাকা বেতন দেওয়ার কথা বললে আমি ও আমার ভাইয়ের জন্য ৮ লাখ টাকা ব্যাংক থেকে লোন উঠিয়ে দেই। পরে আমাদের দেখে আমার এক মামাও যাওয়ার জন্য আড়াই লাখ টাকা জমা দেয়। পরে ঢাকা নিয়ে গিয়ে ৭ দিন রেখে ফ্লাইটের ডেট বলে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। পরে ফোন করে আমাদের বাড়ি চলে আসতে বলে পাসপোর্ট ফিরিয়ে দেয়। কিন্তু এখন টাকা চাইলে টাকা না দিয়ে উল্টো শহর থেকে মাস্তান ভাড়াা করে এনে হুমকি- ধামকি দেয়।
সদর উপজেলার বারঘরিয়া গ্রামের রাসেল আলী বলেন, আমাকে বলেছে সেই খানে মাসে সাড়ে তিন লাখ টাকা বেতন। মাঠে ঘাটে কাজকর্ম করে খাই। বিদেশে গেলে সহজেই বড়লোক হতে পারবো। এই চিন্তায় গরু বেঁচে- লোন নিয়ে তাদেরকে ২ লাখ ২০ হাজার টাকা দিয়েছি। বিভিন্ন সময় নিয়ে যাওয়ার কথা বললে সে (জুলেখা) বলে- আমার বস পালাইছে, এখন নিয়ে যেতে পারবো না। টাকা ফেরত চাইলে বলে- কাগজ পাতি এখনো রেডি হয়নি, কাজ চলছে।
রাজশাহী’র পুঠিয়া উপজেলার ডাঙ্গাপাড়া গ্রামের হাবিবুর রহমান বলেন, ইংল্যান্ড নিয়ে যাওয়ার কথা বলে আমার থেকে ৫ লক্ষ টাকা নিছে প্রায় এক বছর আগে। টাকা নেওয়ার পর কালক্ষেপণ করতে থাকে। পরে গত ৩ মাস আগে লন্ডনে নিয়ে যাবে বলে ৯৭ জনকে ঢাকায় নিয়ে যায়। বেশ কিছুদিন ঢাকায় রেখে কারো সাথে দেখা না করেই সবাইকে বাড়িতে চলে যেতে বলে তারা। বাড়িতে এসে তাদের আর কোনো খোঁজখবর পাইনা। তিনি বলেন, এনজিও থেকে টাকা গুলো সম্পূর্ণ লোন নিয়ে দিয়েছিলাম। এখন এনজিও’র লোকেরা টাকার জন্য বাড়িতে এসে বসে থাকে। আমি পালিয়ে বেড়াচ্ছি।
অপরদিকে এরুপ প্রতারনার ঘটনায় সদর উপজেলার কাফুরিয়া গ্রামের ভুক্তভোগী আবু বকর বাদী হয়ে ১২ জনের নাম উল্লেখ করে সদর থানায় একটি অভিযোগ দায়ের করেন। এজাহারে তিনি উল্লেখ করেন- তিনি সহ ৯৭ জন ব্যক্তিকে ইংল্যান্ডে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে ৫ কোটি ৪৫ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে চক্রটি।
এদিকে টাকা নেওয়ার বিষয়টি শিকার করে অভিযুক্ত জুলেখা আক্তার জুলি বলেন, এলাকার গরীব- দুঃখী মানুষদের উন্নয়ন করতে চেয়েছিলাম। আমার বগুড়ার স্যার এস শাহাজাদা প্রথম আমাকে লন্ডনে লোক নিয়ে যাওয়ার কথা বলেন। পরে আমি ইংল্যান্ডে যাওয়ার কথা এলাকাবাসীর সাথে আলোচনা করলে অনেকেই আমার সাথে যোগাযোগ করতে আসেন। পরে সকল প্রক্রিয়া শেষে যাওয়ার সময় হলে তিনি আমার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দেন। তিনি বলেন- তাকে খুঁজে বের করে গরীব-দুঃখী সব মানুষের টাকা দিয়ে দিব।

এ বিষয়ে সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নাছিম আহমেদ জানান, প্রতিবন্ধী জুলেখা একটি এনজিও’র মাধ্যমে একবার ইংল্যান্ডে যায়। সেখান থেকে ফিরে এসে সাধারণ মানুষের মাঝে আস্থা সৃষ্টি করে প্রচার করে যে তার মাধ্যমে বেশ কিছু মানুষকে ইংল্যান্ডে পাঠাতে পারবে। সহজ সরল মানুষেরা তার সাথে যোগাযোগ করে ২ লাখ থেকে শুরু করে ৪ লাখ পর্যন্ত টাকা প্রদান করেন। মোট ৯৭ জন বিদেশ যাওয়ার জন্য তার কাছে টাকা দেয়। প্রাথমিক তদন্তে জানা যায় তার পরিমান ২ কোটি টাকার মতো।
তিনি বলেন, ভুক্তভোগীরা থানায় অভিযোগ জানালে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনা করে একটি মামলা রেকর্ড ও ৩জনকে গ্রেপ্তার করাহয়। তিনি বলেন প্রধান অভিযুক্ত জুলেখা পলাতক রয়েছেন। তাকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।

Please Share This Post in Your Social Media

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category
COPYRIGHT 2023 sangbadshoily, ALL RIGHT RESERVED
Site Customized By NewsTech.Com