স্টাফ রিপোর্টার
তিন দফা সময়সীমা পেছানোর পর অবশেষে নাটোরের লক্ষীপুর খোলাবাড়ীয়া ইউনিয়নের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রের পরিদর্শিকা সুইটি রানীর অনিয়মের তদন্ত জমা দিয়েছে কমিটি। জেলা পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয়ের উপ পরিচালক মোসাঃ মাহফুজা খানম রোববার সকালে প্রতিবেদন পাবার কথা নিশ্চিত করে জানান, তদন্ত প্রতিবেদনটি রাজশাহী বিভাগীয় কার্যালয়ে পাঠানো হবে। পরবর্তী উর্দ্ধতন কর্মকর্তারা সুইটি রানীর বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন। এর আগে গত ১ জুন তদন্ত কার্যক্রম শুরু করে কমিটি। ১৩ জুন প্রতিবেদন দেবার কথা থাকলেও তা তিন দফায় সময়সীমা বাড়ানো হয়।
জানা যায়, নাটোরের লক্ষীপুর খোলাবাড়ীয়া ইউনিয়নের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে মাতৃত্বকালীন ভাতা কার্ডের জন্য মেডিকেল রিপোর্ট আনতে গিয়ে প্রতারণার শিকার হন শতাধিক সন্তানসম্ভাবা নারী। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, মেডিকেল রিপোর্ট আনতে ঐ কেন্দ্রর পরিদর্শিকা সুইটি রানীর দারস্থ হন তারা। পরে সুইটি রানী তাদের পাঠিয়ে দেন ‘হেলথ কেয়ার’ নামে শহরের চকরামপুর এলাকার একটি ডায়াগনষ্টিক এন্ড কনসালটেশন সেন্টারে। সেখানে চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়াই আলট্রাসনোগ্রাফির পাশাপাশি একগাদা পরীক্ষা করিয়ে হাতিয়ে নেয়া হয়েছে গরীব অসহায়দের চার লক্ষাধিক টাকা।
বিষয়টি বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলে বিষয়টি খতিয়ে দেখতে জেলা পরিবার পরিবার পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয়ের ক্লিনিক্যাল কনট্রাসেপসনের সহকারী পরিচালক আব্দুর রউফ মল্লিককে আহবায়ক এবং সদর উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা হাসানুজ্জামান খানকে সদস্য করে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। পরে গত ১ জুন থেকে তদন্ত কার্যক্রম শুরু করে কমিটি। তারই অংশ হিসাবে ঐদিনই লক্ষীপুর খোলাবাড়ীয়া ইউপি চেয়ারম্যান নুরুজ্জামান কালুর উপস্থিতিতে তার কার্যালয়ে ৫ ভুক্তভোগী ও তাদের স্বজনদের সাক্ষাৎকার লিপিবদ্ধ করা হয়। এরপর তদন্ত কমিটি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রর পরিদর্শিকা সুইটি রানীরও জবানবন্দি গ্রহন করে।
সদর উপজেলার গাজিপুর বিল এলাকার জরিনা খাতুন জানান, মাতৃত্বকালীন ভাতা কার্ডের আবেদনের প্রয়োজনে মেডিকেল রিপোর্টের জন্য ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রের পরিদর্শিকা সুইটি রানীর দারস্থ হন তিনি। পরে সুইটি রানী তাকে পাঠিয়ে দেন ‘হেলথ কেয়ার’ নামে শহরের একটি ডায়াগনষ্টিক সেন্টারে। সেখানে আলট্রাসনোগ্রাফির পাশাপাশি অভিজ্ঞ চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়াই একগাদা পরীক্ষা করে নেয়া হয় ১৬শ টাকা।
একই অভিযোগ করেন, পাশ্ববর্তী আটঘরিয়া গ্রামের গৃহবধু শাহিদা। তিনি জানান, বনপাড়ার জাহেদা হাসপাতাল থেকে তিনি আলট্রাসনোগ্রাফি করান। সেই রিপোর্ট নিয়ে সুইটি রানীর কাছে গেলে তার স্বাস্থ্য পরীক্ষার আগের কাগজপত্র চলবে না বলে জানান সুইটি। পরে হেলথ কেয়ারে নানা পরীক্ষার মাধ্যমে হাতিয়ে নেয়া হয় ২৫শ টাকা। পুরো ইউনিয়নে সাথী, পাপিয়া, জেসমিন, আঁখি, লাইলি, আলেয়া সহ ১৩২ জন নারীর সাথে একই ঘটনা ঘটেছে দাবী করে ঘটনাটি সুষ্ঠু তদন্ত করে ব্যবস্থা নেবার দাবী জানিয়েছেন রোগীর স্বজন ও এলাকাবাসি। এ নিয়ে স্থানীয় চেয়ারম্যানের বরাবর লিখিত অভিযোগও দিয়েছিল ভুক্তভোগীরা।
এ বিষয়ে ডাঃ পরিতোষ কুমার রায় জানান, একজন নারী সন্তানসম্ভাবা কিনা তা জানার জন্য প্রাথমিক পর্যায়ে এতোগুলো পরীক্ষার প্রয়োজন নেই। শুধুমাত্র মুত্র পরীক্ষার মাধ্যমেই বিষয়টি জানা যায়। আরেকটু নিশ্চিত হবার জন্য বড়জোড় আলট্রাসনোগ্রাফি করা যেতে পারে। এছাড়া সংশ্লিষ্ঠ বিষয়ে অভিজ্ঞ চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়া স্বাস্থ্য পরিক্ষা করারও বিধান নেই।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়া এতোগুলো পরীক্ষা কেন করানো হলো? সেই প্রশ্নের সদুত্তর মেলেনি হেলথ কেয়ার ডায়াগনষ্টিক এন্ড কনসালটেশন সেন্টারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা. ইসমাইল হুসাইনের কাছে। তবে সুইটি রানীর সাথে সংখ্যতার বিষয়টি অকপটে স্বীকার করেন তিনি।
ডা. ইসমাইল হুসাইন জানান, রোগীরা এসে যে যে পরীক্ষা করতে বলেছে আমরা শুধু সেই পরীক্ষাগুলোই করেছি। সুইটি রানী স্বাস্থ্য সেক্টরে একজন সরকারী কর্মকর্তা। এই হিসাবে ওনার সাথে আমাদের একটা সুসম্পর্ক রয়েছে। ওনি প্রয়োজন মনে করলে অনেক সময় তার পরিচিত জনকে আমাদের এখানে চিকিৎসার জন্য পাঠান।
নিজের বিরুদ্ধে আনা সকল অভিযোগকে মিথ্যা ও বানোয়াট বলে দাবী করছেন অভিযুক্ত সুইটি রানী। তিনি বলেন, তার বিরুদ্ধে আনা সকল অভিযোগ মিথ্যা ভিত্তিহীন ও ষড়যন্ত্রমুলক। তিনি কাউকে হেলথ কেয়ার ডায়াগনষ্টিক সেন্টারে পাঠাননি। তিনি দাম্ভিকতার সাথে আরও বলেন তার বিরুদ্ধে রিপোর্ট করতে হলে দুইবার ভাবতে হবে।
এবিষয়ে লক্ষীপুর খোলাবাড়ীয়া ইউপি চেয়ারম্যান নুরুজ্জামান কালু জানান, ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রের কর্মকর্তাদের দেয়া মেডিকেল রিপোর্টের ভিত্তিতেই মাতৃত্বকালীন ভাতার কার্ডের আবেদন করা যায়। গরীব অসহায় দুঃস্থ গর্ভবতী নারীদের কাছ থেকে কৌশলে অর্থ হাতিয়ে নিয়ে পরিবার কল্যাণ পরিদর্শিকা সুইটি রানী ন্যাক্কারজনক কাজ করেছেন। এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে অভিযুক্তের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবার দাবী জানান তিনি।
তদন্ত কমিটির আহবায়ক আব্দুর রউফ মলিক জানান, ১৩ জুনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেবার কথা ছিল। কিন্তু নির্দিষ্ট সময়ে তদন্ত কার্যক্রম শেষ না করায় তা বাড়িয়ে প্রথমে ২০ জুন ও পরে ২৬ জুন নির্ধারণ করা হয়। তবে সেই তারিখেও প্রতিবেদন দেয়া সম্ভব হয়নি। ইতিমধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়া হয়েছে। প্রাতমিকভাবে সুইটি রানীর অনিয়মের প্রমান মিলেছে। কর্তৃপক্ষ পরবর্তী সুইটি রানীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেন।