স্টাফ রিপোর্টার
নাটোর শহরের লালবাজারের আলোচিত গৃহবধু সুমি রানী সাহা হত্যা মামলায় দেয়া পুলিশের চুড়ান্ত প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে করা নারাজি আবেদন গ্রহন করে পিবিআইকে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে আদালত। মঙ্গলবার(২৫ জুলাই) বিকেলে নাটোরের অতিরিক্ত চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক রওশন আলম এই আদেশ দেন।
নাটোর আদালত (সদর) জিআরও খাদেমুল ইসলাম জানান, সুমী রানী সাহা হত্যা মামলার (নং ১৬৩/২৩) বাদির আইনজীবি মনজুরুল আলম পুলিশের চুড়ান্ত প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে নারাজি আবেদন করেন। শুনানী শেষে বিচারক রওশন আলম নারাজী আবেদন গ্রহন করেন এবং মামলাটি পিবিআইকে তদন্তের নির্দেশ দেন। পরবর্তী দিন ধার্য করা হয়েছে আগামী ১১ অক্টোবর।
জানা যায়, বাদী-স্বাক্ষীর জবানবন্দি না নিয়েই মাত্র ২ মাস ১০ দিনেই একটি চাঞ্ছল্যকর গলা কেটে হত্যা মামলার চুড়ান্ত প্রতিবেদন দেয়ার অভিযোগ উঠে নাটোর সদর থানার পুলিশের বিরুদ্ধে। রংপুরের বদরগঞ্জের বাসিন্দা সুমি রানী সাহা নামের ওই গৃহবধুর লাশ গত ৬ ফেব্রুয়ারী নাটোরের লালবাজার এলাকায় স্বামী স্বপন সাহার বাড়িতে গলাকাটা অবস্থায় উদ্ধার করেছিল পুলিশ। হত্যাকান্ডের শিকার সুমী রানী সাহার ভাই ও মামলার বাদি পার্থ সাহা বলেন, ঘটনার পরপরই পুলিশের সুমীর নাটোর সদর হাসপাতাল হয়ে লাশ নেয়া হয় রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। পরের দিন ময়নাতদন্ত শেষে তড়িঘড়ি লাশ দাহ করে স্বামী ও তার পরিবার। ঘটনার পর থেকে সদর থানার ওসি নাছিম আহম্মেদসহ অন্যান্যদের কাছে ধর্ণা দিয়েও মেলেনি সহযোগিতা, হত্যা মামলাও নেয়নি পুলিশ। বাধ্য হয়ে আমি আদালতে মামলা করি।
পার্থ সাহার অভিযোগ, সুরতহাল রিপোর্ট তৈরির সময় সেখানে থাকা রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের রাজপাড়া থানার এসআই প্রবীর কুমার, ডিবি অফিসার মিঠুন সরাসরি আমার জামাইবাবুর কাছে ম্যানেজ হয়ে ময়না তদন্তকারী চিকিৎসককে প্রভাবিত করেছে। এছাড়াও নাটোর সদর থানার ওসি নাছিম আহম্মেদ, এসআই মোখলেছুর রহমান আমার জামাই বাবু ও তার পরিবারের সাথে যোগসাজস করে ঘন্টার পর ঘন্টা আমিসহ আমার পরিবারের লোকজনকে থানায় অবস্থান করিয়েছে এবং আমার মামলা নেয় নি। বরং কালক্ষেপন করে দিদিকে মাটি দেয়ার পরিবর্তে দাহ করার সুযোগ করে দিয়েছে। আমি ওসি নাছিম আহম্মেদের রুম গিয়ে মামলা করার কথা বললে, তিনি বলেন, এখন এসে লাভ কি? লাশ তো পুড়িয়ে ফেলেছে। এখন কি করবেন? এখন আর এ বিষয়ে কোন মামলা হবে না। ইউডি মামলা হয়েছে। সেটা আগে নি®পত্তি হোক। আমি বার বার ওসি সাহেবকে অনুরোধ করলে তিনি বলেন, আপনারা হিন্দু মানুষ। এসব মামলা টামলা করে কোন লাভ নাই। যে যাবার গেছে। এখন বাচ্চা দুটোর কথা ভেবে মিটমাট করে নেন।
পার্থ সাহার দাবি, আমি ওসি নাছিম আহেম্মেদের কথায় কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে যাই। থানায় ২ ঘন্টারও বেশি অবস্থান করে পরিবারের লোকজনসহ ফিরে আসি। পরবর্তীতে ১৭-০২-২৩ তারিখে আমি বাদি হয়ে নাটোর সদর আমলী আদালতে মামলা করি। আদালতের আদেশে ২২-০২-২০২৩ তারিখে সদর থানা কর্তৃপক্ষ মামলাটি এজাহার হিসেবে গ্রহন করে এসআই সাইমুম পারভেজকে তদন্তের নির্দেশ দেন। কিন্তু তদন্ত কর্মকর্তার সাথে একাধিকবার যোগাযোগ করেও তিনি আমার সাথে কোন ধরণের কথা না বলতে চান নি। উল্টো তদন্ত কর্মকর্তা খন্দকার সাইয়ুম পারভেজও আমার জামাই বাবু ও তার পরিবারের লোকজনের দ্বারা ম্যানেজ হয়ে একটি নৃশংস গলাকেটে হত্যার ঘটনার ২ মে চুড়ান্ত প্রতিবেদন নেয়। আমি মনে করি এটি নজীরবিহীন ঘটনা।
পার্থ সাহা আরও জানান, আমার দিদি হত্যার পর পুলিশের নজীরবিহীন গড়িমসির বিষয়ে রাজশাহী রেঞ্জ ডিআইজি, নাটোর পুলিশ সুপারসহ বিভিন্ন দপ্তরে আবেদন করেছি। কিন্তু এখনও তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা হয়নি।
পার্থ সাহার দাবি, আমি মনে করি আমার জামাই বাবু ও তার পরিবারের লোকজন পুলিশ এবং হাসপাতালের মর্গে মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে ম্যানেজ করে একটি হত্যা মামলার চুড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেছে। আমি আমার বোন হত্যার বিচার চাই। আদালত পিবিআইকে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে। পিবিআই সঠিক তদন্ত করবেন বলে আশাবাদি পার্থ সাহা। এছাড়াও তিনি অভিযুক্ত পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহনেরও দাবি জানান।
সুমী রানীর মা এসোনা রানী জানান, আমার এক মেয়ে পানিতে পড়ে মারা গেছে। আরেক মেয়ে মারা গেছে ক্যান্সার হয়ে। আর এই মেয়েকে জামাই ও তার পরিবারের লোকজন গলা কেটে হত্যা করলো। আমি আমার মেয়ে হত্যার বিচার চাই।
সুমী রানীর বাবা রবীন্দ্র নাথ সাহা জানান, আমার আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। এখন আমরা চাই সঠিক তদন্ত প্রতিবেদন। এবং আমরা যে ডিআইজিসহ বিভিন্ন দপ্তরে পুলিশের গড়িমসির বিরুদ্ধে আবেদন করেছি সেসব পুলিশের যথাযথ বিচার করতে হবে। এসব বিষয়ে জানতে গেলে নাটোর সদর থানার ওসি নাছিম আহম্মেদ কাগজপত্র দিতে চাইলেও কথা বলতে চান নি। তার দাবি, বিষেশজ্ঞ প্রতিবেদনের কারনেই দেয়া হয়েছে চুড়ান্ত রিপোর্ট। এ নিয়ে নিজের বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্ত হওয়ার কথা স্বীকার করলেও এসব অভিযোগ থোরাই কেয়ার’ না করার কথা বলেন ওসি। তবে স্বামী স্বপন সাহাসহ ও পরিবারের দাবি বাথরুমে নিজেই নিজের গলা কেটে নিজ ঘরের সামনে এসে পড়ে গিয়েছিল সুমিরানী। শুধু তাই নয়, সুমিসহ পরিবারের সবাইকে পাগলও বলছেন তারা।
স্বামী স্বপন সাহা বলেন, আমাদের পরিবারকে ধ্বংস করার জন্যই এই মামলা করা হয়েছে। এটা মিথ্যা মামলা। আমার বউ আঠারো বছর ধরে পাগল। আমার বউ যে পাগল সেজে পাগলের ওষুধ খায় তার প্রেসক্রিপশন আমার কাছে আছে। আর প্রথম পাগল ওর বাপ, তারপর ও মা পাগল, ভাই পাগল, ব্যাটার বউ পাগল, ওরা সব পাগলের গোষ্ঠি।
সুমী সাহার শশুড় রনজিত কুমার ওরফে টেপা সাহা জানান, আমরা কারো কাছে যাইও নি। পুলিশকে ম্যানেজও করিনি। পুলিশ তদন্ত করে চুড়ান্ত রিপোর্ট দিয়েছে।
সুমি রাণীর ৮ বছরের অর্চিন সাহা ৪ বছরের অর্থিসাহা নামে দুটি সন্তান আছে।তারা এখন নাটোরের লালবাজারে দাদা বাড়িতে অবস্থান করছেন।