রেজাউল করিম রেজা
বাঙালি জাতির হাজার বছরের শৌর্যবীর্য ও বীরত্বের এক অবিস্মরণীয় গৌরবময় দিন। বীরের জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার দিন। পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন ভূখণ্ডের নাম জানান দেওয়ার দিন।
বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, ছেষট্টির ছয় দফা, উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, একাত্তরের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ, ২৫ মার্চে গণহত্যা শুরু হলে ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা, পরদিন চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকে মেজর জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ , ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠন এবং রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে ৩০ লাখ শহীদ ও দু’লাখ মা-বোনের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত হয় স্বাধীনতা। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাক সেনাদের আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয়। সেই হিসাবে বিজয়ের ৫৩ বছর পূর্তির দিনকাল।
জাতীয় পর্যায়ে এদিন ঢাকায় প্রত্যুষে ৩১ বার তোপধ্বনির মাধ্যমে দিবসটির সূচনা হয়। সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধান উপদেষ্টা ড. মোহাম্মাদ ইউনুস সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুস্পস্তববক অর্পণ করবেন।
দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী বাণী দিয়েছেন। দিবসের তাৎপর্য তুলে ধরে এদিন সংবাদপত্র বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করেছে। ১৬ই ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবস। রক্তস্নাত বিজয়ের ৫৩তম বার্ষিকী। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের দিন। দীর্ঘ ৯ মাস সশস্ত্র সংগ্রাম করে বহু প্রাণ আর এক সাগর রক্তের বিনিময়ে এদিনে বীর বাঙালি ছিনিয়ে আনে বিজয়ের লাল সূর্য।
পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এদেশের মুক্তিকামী মানুষের ওপর অত্যাচার-নির্যাতনের পর এদিন আত্মসমর্পণ করে মুক্তিকামী মানুষের কাছে। আর পাকিস্তানি বাহিনীর এই আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে সমাপ্তি ঘটে দীর্ঘ দুই যুগের পাকিস্তানি শোষণ আর বঞ্চনার। নির্যাতন, নিষ্পেষণের কবল থেকে মুক্ত হয় বাঙালি জাতি।
এখন ৫৩ বছরের প্রাপ্তি ও প্রত্যাশার বিশ্লেষণ হচ্ছে সর্বত্র। ৫ আগস্ট ছাত্র জনতার গণ অভ্যুথ্থানের পর আজ পরম শ্রদ্ধা আর ভালবাসায় পুরো জাতি স্মরণ করবে মুক্তিযুদ্ধে আত্মদানকারী লাখো শহীদদের। যাদের জীবন উৎসর্গে আমরা পেয়েছি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। একই সঙ্গে প্রত্যয় ব্যক্ত হবে সমৃদ্ধ আগামীর নতুন বাংলাদেশ গড়ার। দিবসটি উপলক্ষে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে পালিত হবে নানা কর্মসূচী। দিবসটি উপলক্ষে সকালে সারা দেশের সকল সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে জাতীয় পতাকা ওড়ানো হবে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পালিত হবে নানা কর্মসূচি।
১৭৫৭ সালে পলাশীর আম্রকাননে স্বাধীনতার যে সূর্য অস্তমিত হয়েছিল সেটির উদয় ঘটে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। বিজয়ের মহামুহূর্তটি সূচিত হয়েছিল আজকের এই দিনে। ৯১ হাজার ৫৪৯ পাকিস্তানি সৈন্য প্রকাশ্যে আত্মসমর্প করার মধ্য দিয়ে পৃথিবীতে নতুন একটি রাষ্ট্র হিসেবে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে।
বস্তুত:বাংলাদেশের স্বাধীনতার মাহেন্দ্রক্ষণ একদিনে আসেনি। এর পেছনে রয়েছে এই জাতির ঘাম ঝরানো সংগ্রাম।
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পেছনেও ছিলো বাঙালিদের অবদান। বাঙালিরাই ছিলো পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মূল কারিগর। কিন্তু কয়েক বছরেই বাঙালির স্বপ্নভঙ্গ হয়। যে শোষণ বঞ্চনার বিরুদ্ধে তারা ইংরেজদের বিতাড়িত করেছিলো সেই একই রকম শোষণ বঞ্চনার মুখোমুখি হয়ে পড়ে কয়েক বছরের মধ্যেই। শুরু হয় সংগ্রামের নতুন যুগ। পাকিস্তানীরা এ ভূখন্ডের মানুষকে তাদের তাঁবেদার মনে করতো। অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক সর্বক্ষেত্রেই তারা বঞ্চিত করতো বাঙালিদের। এমনকি নির্বাচনের ফলাফল মেনে নিতেও তারা অস্বীকার করতো। ৫২’র ভাষা আন্দোলন, ৬৬’র ঐতিহাসিক ৬ দফা আন্দোলন, ৬৯’র গণ অভ্যুত্থান এ সবই ইতিহাসের বাঁক ঘুরিয়ে দেয়। ১৯৭০ সালের নির্বাচন সব পরিণতিকে দিয়ে দেয় চূড়ান্ত রূপ। শুরু হয় নতুন অধ্যায়। ১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চ পাক বাহিনীর গণহত্যার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় সমগ্র বাঙালি জাতি ।শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ । দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয় সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে চূড়ান্ত বিজয় ছিনিয়ানে বাংলার দামাল ছেলেরা। প্রায় ৯০ হাজার পাকিস্তানী বাহিনী আজকের এই দিনে রেসকোর্স ময়দানে আত্মসমর্পণের মধ্যদিয়ে পরাজয় বরণ করে।
কিন্তু ৫৩ বছরেও আমরা আমাদের কাঙ্খিত অধিকার প্রতিষ্ঠা হয়নি। আজও লড়াই করতে হচ্ছে মানুষের মৌলিক অধিকার ও ভোটের জন্য। একটি স্বাধীন বাংলাদেশে গনতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য। ৫ আগস্টের গণ অভ্যুথ্থানের মধ্য দিয়ে জাতী নতুন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় দৃঢ় প্রত্যয়ী।সুখ সমৃদ্ধির নতুন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় চেয়ে রয়েছে ১৮ কোটি মানুষ। আমাদের রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনে উদ্যমী সকলে সেই স্বপ্ন পূরণে অগ্রনী ভুমিকা পালন করবে এটাই আমাদের প্রত্যাশা।লেথক -সাংবাদিক ও কলামিষ্ট।